সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলা সাহিত্যের একজন স্বতন্ত্র, প্রজ্ঞাবান, মেধাবী লেখক; যাঁর আবির্ভাবটাই অন্যরকম। কেননা বাংলাদেশের অনগ্রসর মুসলিম সমাজ এবং সাহিত্যে সেই সমাজব্যবস্থা প্রকাশের আধুনিক আঙ্গিকরীতি নিয়ে সম্ভবত তিনিই ভেবেছিলেন প্রথম। যদিও শুরুতে যথেষ্ট দ্বিধা ছিল তাঁর ভেতরে, বন্ধুপ্রবর বিশিষ্ট লেখক কাজি আফসারউদ্দিনকে ১৯৪৩ সালে লেখা একটি চিঠিতে নিজেকে অভিব্যক্ত করেছেন তিনি এভাবে- “লরেন্সের কথা [-য়] আমার সম্পূর্ণ সায় রয়েচে। সাহিত্যিক হতে হবে ব’লে লেখা; সে আমি ঘৃণা করি। প্রাণের উৎস থেকে না বেরুলে সে আবার লেখা! আপনা থেকে যা বেরুবে তা-ই খাঁটি; লেখকের পক্ষ থেকে বিচার করলে, (পাঠকের কাছে বিচার পরে, তার জন্যে শেষোক্ত লেখকের মাথা ঘামাবার প্রয়োজন রয়েছে মনে করি না।) তবে সমাজকে নিয়ে লেখা না-লেখা সম্বন্ধে আপনার সাথে হয়তো আমার কিছুটা মতানৈক্য রয়েচে, তার জন্যে বিশেষ দুঃখিত। কিন্তু কথা হচ্ছে যে “I want to write” মুসলমান সমাজ নিয়ে; আমার সমগ্র মনের ইচ্ছে সেদিক পানে। এও একরকম passion থেকে সৃষ্ট। মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে আমরা কেউ হয়তো অজ্ঞ নই; কিন্তু অধঃপতনের এই যে একটা চূড়ান্ত অবস্থা; এই অবস্থা নিয়ে লিখে আমার লেখা কলঙ্কিত (?) করতে চাই। আমার দুয়েকটা গল্প দার্শনিক হলেও আমি দার্শনিক নই। আমি আমার আঁকা ছবিতে সে-সমাজকে প্রতিফলিত করতে চাই, যাতে তাতে তারা নিজের সুষ্ঠু চেহারা দেখবার সুযোগ পায়। পশ্চিম জগত আজ যতখানি এগিয়েছে ততখানি এগুতে আমাদের ঢের দেরী। ব্যক্তিগতভাবে আমি হয়তো ততখানি এগিয়ে যাবো বা ছাড়িয়ে যাবো, কিন্তু আমার লেখা পিছিয়ে রাখবো তাদের জন্যে যারা পিছিয়ে আছে। তাতে আমার ক্ষোভ নেই, এবং এতে বড় রকম একটা ঝধপৎরভরপব হবে অনেকে বলতে পারেন কিন্তু তাতে আনন্দ নেই, আছে সেই জ্ঞানে যে আমি নিজে মানুষ হিসেবে উৎরে গেলাম, ওরাও যুগোপযোগী সাহিত্য পেলো, যে-সাহিত্যে কিছুটা হয়তো ভবিষ্যতের স্বপ্নের সোনা ছড়িয়ে থাকলো।” কেন এই কলঙ্কের দ্বিধা? প্রাক্তনরীতি ভাঙ্গবার অবরুদ্ধ যন্ত্রণাই হয়ত এর কারণ। আর ‘পাঠকের কাছে বিচার’ নিয়ে সত্যিই মাথা ঘামাননি তিনি; ১৯৪৮ এ নিজস্ব প্রকাশনা কমরেড পাবলিশার্স থেকে যখন তাঁর প্রথম উপন্যাস লালসালু বের করেন বিশ-পঞ্চাশ কপি মাত্র বিক্রি হয়, অবশিষ্ট কপি ‘সের দরে ওজন ক’রে বেচে দেয় বাঁধাইখানার লোকজনেরা।’ যে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত গ্রামীণ সমাজকে প্রতিফলিত করলেন তিনি তাঁর উপন্যাসে, সম্পূর্ণ মুসলিম অধ্যুষিত জীবন-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের ধর্মবোধ ও সংস্কারের প্রতি তা ছিল আঘাতস্বরূপ, ‘নিজের সুষ্ঠু চেহারা দেখবার সুযোগ’ থাকলেও তাই পাঠক কিংবা সমালোচক উপন্যাসটি নিয়ে উৎসাহবোধ করেননি তেমন। লেখকের নিজস্ব ভূমিকাও এক্ষেত্রে শীতলই ছিল বলতে হয়; সৈয়দ আবুল মকসুদের দেয় তথ্যানুসারে, ‘প্রকাশের পরপরই কার্যোপলক্ষে ওয়ালীউল্লাহ্ প্রথমে করাচী বেতারকেন্দ্রে, এবং পরে নয়াদিল্লী বদলি হয়ে যান। তাতে ক’রে বইটির প্রচারের ব্যাপারে তিনি খুব সামান্যই সময় দিতে পেরেছিলেন।’ প্রকৃতঅর্থে লালসালুর চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য সময় লেগেছিল দীর্ঘ বারোটি বছর; ১৯৬০ সালে ঢাকার কথাবিতান প্রকাশনা থেকে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় এবং ১৯৬১ সালে শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান, একই সালে অ্যান-মারি তিবো ওয়ালীউল্লাহ্ প্যারিসে Edition du Seuil থেকে লালসালুর ফরাসি অনুবাদ L’ Arbre sans raciness প্রকাশ করেন, ১৯৬৩তেই প্রকাশিত হয় এর পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ। ফ্রান্সের একাধিক পত্রিকায় ও বেতারে বইটির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। ফলস্বরূপ ‘বাংলাদেশের স্থানীয় পাঠকদের বইটি সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহ জাগে, পরিণামে বইটি বছরে বছরে দ্রুত পুনর্মুদ্রিত হয়ে চলে।’ সৈয়দ আবুল মকসুদের এই উক্তি লালসালুর জনপ্রিয়তা ও শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রমাণ করে। ১৯৬৭ সালে লন্ডন Chatto & Windus থেকে প্রকাশিত হয় লালসালুর ইংরেজি অনুবাদ Tree Without Roots। এছাড়াও লালসালু জর্মন ও চেক ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। লালসালুর দুর্দমনীয় এই জনপ্রিয়তার কারণও আজ সর্বজনবিদিত; সে উপন্যাসটির সার্বিক স্বাতন্ত্র্যে; বিষয়গত দিক থেকে তো বটেই, আঙ্গিকগত বিচারেও। লালসালুর স্বাতন্ত্র্য এবং বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় এর শিল্পমূল্যের কাছে। বিভাগোত্তর সাহিত্যের ধারায় লালসালুর বিশিষ্টতা অত্যন্ত স্পষ্ট; যেভাবে তিনি মজিদ চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন, দোষ আর অনৈতিকতার অতলে ডুবে থেকেও একজন সামাজিক মানুষ, আত্ম-প্রতিষ্ঠার নিরন্তর লড়াইয়ে যে অনবরত ক্ষত-বিক্ষত। অর্থাৎ চরিত্রটিকে তিনি পাঠকের বোধের সমান্তরালে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছেন। সমসাময়িক মুসলিম-চেতনাধর্মী অন্যান্য উপন্যাসগুলির মতো আদর্শযুক্ত বা আদর্শচ্যুতির বিন্যাস থেকে নয়, লালসালুর মজিদ তার পেশাগত আচার-আচরণ থেকে যেমন তেমনি তার অন্তস্থ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেও সম্পূর্ণ। এই সম্পূর্ণতাই উপন্যাসটির প্রকৃত শিল্পসৌন্দর্য। যে কারণে মাজার বা ধর্মব্যবসার মতো একটি বহুল চর্চিত সমাজসত্যকে তুলে ধরতে গিয়ে শিল্পের সূক্ষতাকে ব্যবহার করেছেন তিনি, লাল সালু কাপড়ে ঢাকা ‘মাছের পিঠের মতো চির-নীরব মাজার’ আর জমিলার যথোচিত ও স্বভাবসুলভ আচার-আচরণের মধ্যেই গেঁথে দিয়েছেন আপাদমস্তক স্থবির-কুসংস্কারা”ছন্ন গ্রামীণ জীবনব্যবস্থার প্রতি নিঃশব্দ অথচ সরব প্রতিবাদী বার্তা। সৈয়দ আবুল মকসুদ যথার্থই বলেছেন, ‘সার্বিকভাবে বাঙালি মুসলমানসমাজ নিশ্চেতন। “মাছের পিঠের মতো চির-নীরব মাজারটির” মতোই নিশ্চেতন সেই সমাজের চৈতন্যে ‘লালসালু’ একটি চাবুক। এ চাবুক হেনেছেন শিল্পি ওয়ালীউল্লাহ্; একজন passionate শিল্পীর প্রতিবাদ এভাবেই হয়ঃ নির্জনে, নিঃশব্দে।’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-এর অপর দুটি উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা এবং কাঁদো নদী কাঁদোও একই ‘passion থেকে সৃষ্ট’। যদিও লালসালু থেকে উপন্যাস দুটির প্রকাশকালের ব্যবধান
চৌদ্দ থেকে বিশ বছর; চাঁদের অমাস্যা ১৯৬৪ সালে এবং কাঁদো নদী কাঁদো ১৯৬৮ সালে। দুটি উপন্যাসই নিরীক্ষাধর্মী, একটিতে এসেছে মানব-অস্তিস্ত্বের প্রসঙ্গ, অপরটিতে মানব- চৈতন্যের ব্যবহার। অর্থাৎ বাংলাদেশের সমসাময়িক সাহিত্যরীতির ধারাবাহিকতায় আবারও দুই ভিন্ন অভিধাযুক্ত সংযোজন। ঘটনায়-বিষয়ে-প্রকরণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-এর অভিনিবেশ তখন চল্লিশোত্তর কথাসাহিত্যিকদের এলাকায়; এক গভীরতর জীবন-অন্বেষণে ব্যাপৃত এই ধারার সুবোধ ঘোষ (১৯১০-১৯৭০), নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৫), জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী (১৯১২-১৯৮২), সন্তোষকুমার ঘোষ (১৯২০-১৯২৫), বিমল কর (১৯২১-২০০৩) প্রমুখের মতো বিশিষ্ট কথাশিল্পীরা। বিশ্বসাহিত্যের তাবৎ আধুনিক শৈলী এবং মতবাদে আলোড়িত ও উদ্দীপিত এঁদের সাহিত্যধারা; বাস্তবকে অস্বীকার করে নয়, বাস্তবের সূক্ষ্ম অন্বেষণেই নিজেদের বোধ এবং বিশ্বাসকে Realism, Socialism, Existentialism, Expressionism, Surrealism-এর মতো জটিল জীবন-বীক্ষায় স্থাপন করে নিতে দেখা যায় তাঁদের। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ও এই ধারার অন্তর্ভুক্ত একজন। ফরাসি-রাজধানী প্যারিসে সুদীর্ঘকাল অবস্থানের ফলে উপর্যুক্ত আন্দোলনসমুহকে গভীরতর নিষ্ঠায় পর্যবেক্ষণ এবং গ্রহণ করতে সমর্থ হন তিনি। ‘ফ্রান্সের আলপ্স্ পর্বত অঞ্চলের পাইন-ফার-এল্ম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে’ বসে যখন চাঁদের অমাবস্যা লিখলেন, অধিকাংশ সমালোচকের চোখে উপন্যাসের বিষয় এবং ঘটনা সংস্থানে প্রকট হয়ে দেখা দিল সার্ত্র নির্দেশিত অস্তিত্ববাদী রূপরেখা; ব্যক্তির স্বাধীনতা, দায়িত্ব এবং দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার দর্শন। কেননা উপন্যাসটিতে বহির্জাগতিক সচেতনতার সংকোচন ঘটিয়ে প্রসারিত করা হয়েছে প্রধান চরিত্র আরেফ আলীর অন্তশ্চেতনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবৃতি বা বিশ্লেষণ। গ্রাম্য-দরিদ্র-স্কুলশিক্ষক যুবক বয়সী এই চরিত্রটি নিজের অজান্তেই অন্যায়ভাবে সংঘটিত একটি হত্যাকা-ের নিরীহ শিকার হয়ে পড়ে; অথচ প্রকৃত হত্যাকারী কে তা সে জানে, কিন্তু নিজস্ব অবস্থান থেকে হত্যাকারীকে সনাক্তকরণে চরমভাবে দ্বিধান্বিত এবং আত্মপীড়িত হতে হয় তাকে। শেষপর্যন্ত স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের, দায়িত্বভার অর্জনের এবং দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার অপরিসীম শক্তি নিয়ে আইনের দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছুতে সমর্থ হয় যুবকটি। সমাজস্থিত ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ভণ্ডামির মুখোশ ছিঁড়ে বিশ্বাস এবং সত্যের পুনর্যাত্রা দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছে উপন্যাসের। মানব-উপলব্ধির চূড়ান্ত বিন্যাস এবং বিস্তার সমৃদ্ধ এই উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যের ভুবনে ‘এক দুরন্ত দৃষ্টান্ত’স্বরূপ। এমনই যুক্তিহীন বিশ্বাস এবং সংস্কারের পুনরাবৃত্তি দেখা যায় কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসেও। এখানেও ব্যক্তির বহির্দেশ থেকে অন্তর্দেশে প্রবেশের সুযোগ রেখেছেন লেখক, ক্ষেত্রবিশেষে মানবচৈতন্যকেই অবলম্বন করে আঘাত হানতে চেয়েছেন মানুষের চিরকালীন লালিত সংস্কারে। চাাঁদপাড়া গাঁ-এর দুবৃত্তপরায়ণ পিতার শিক্ষিত সন্তান কুমুরডাঙ্গার ছোট হাকিম মুহাম্মদ মুস্তফার আবাল্য কু-লায়িত কুসংস্কারবোধ, পরকালভীতি, অতিপ্রাকৃতবিশ্বাস একদিকে যেমন কালোছায়ার বিস্তার ঘটিয়েছে তার মানসলোকে, তেমনি ক্রমান্বয়ে গ্রাসা”ছাদিত করে চলেছে নদী তীরস্থ একটি গোটা জনপদের বিচিত্র জীবনধারায় টিকে থাকা মূঢ়, সাধারণ মানুষগুলোকেও। এভাবে একক চেতনাকে বহুর চেতনায় ভাসিয়ে দেয়া বা বহুর চেতনাকে একজনের চেতনায় কেন্দ্রীভূত করার এই রীতি চেতনাপ্রবাহধর্মীতারই রীতি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কাঁদো নদী কাঁদোর আখ্যান, আঙ্গিক এবং ভাষার গঠনে এই রীতিরই অনুসারী। কাজেই সাতচল্লিশ-উত্তর নবজাগ্রত মুসলিম মূল্যবোধ ও চেতনার নীতিগত আদর্শকে মাথায় রেখেই কেবলমাত্র সাহিত্যচর্চা করেননি তিনি; সমধারার আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮), শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮), সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮-১৯৮৬), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩) প্রমুখের মতো মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামীণ কথকতা মুখ্য পটভূমি হিসেবে রেখেও ভিন্ন নিরীক্ষায় উদ্দীপিত তাঁর উপন্যাস রচনার কৌশল। পাশ্চাত্য সাহিত্যরীতির ‘অতি আধুনিক আঙ্গিক ও বিষয়ভাবনাকে আত্মস্থ’ করেই হয়ত তিনি সম্পূর্ণভাবে ‘এগিয়ে গেছেন বা ছাড়িয়ে গেছেন’ প্রচলিত রীতিসমূহ, এতে করে ‘আমার লেখা পিছিয়ে রাখবো তাদের জন্যে যারা পিছিয়ে আছে’; কথাটি সত্যতা হারিয়ে কেবলই বিনয় হয়ে উঠেছে হয়ত বা; বলাচলে চিঠির শেষ কথাগুলোই তাঁর সাহিত্যরীতি এবং শিল্পদৃষ্টির মূলমন্ত্র হিসেবে সত্যে পরিণত হয়েছে; ‘তাতে আমার ক্ষোভ নেই, এবং এতে বড় রকম একটা sacrifice হবে অনেকে বলতে পারেন কিন্তু তাতে আনন্দ নেই, আছে সেই জ্ঞানে যে আমি নিজে মানুষ হিশেবে উৎরে গেলাম, ওরাও যুগোপযোগী সাহিত্য পেলো, যে-সাহিত্যে কিছুটা হয়তো ভবিষ্যতের স্বপ্নের সোনা ছড়িয়ে থাকলো।’ তাঁর রচিত নাটকগুলিও এই যুগোপযোগিতার বাইরে নয়। বহিপীর, তরঙ্গভঙ্গ, সুড়ঙ্গ, উজানে মৃত্যু; প্রতিটি নাটকই কোনো না কোনো দিক থেকে বিশ্বনাট্যআন্দোলনের যুগোপযোগী নিরীক্ষার নিদর্শন। অস্তিত্ববাদ-অভিব্যক্তিবাদ-এ্যাবসার্ডধর্মিতা-রূপকধর্মিতা তাঁর নাটকের শিল্পআবরণ। এই শিল্পকে প্রত্যুজ্জ্বল রেখেই তিনি তুলে ধরেছেন স্বদেশ-স্বসমাজের ঘনিষ্ঠচিত্র; পুরনো ঘুণেধরা মূল্যবোধের অপসারণে সৃষ্টি করেছেন ভ-পীরের বদলে বহিপীরের, যে তরুণী স্ত্রীকে প্রেমিকের হাতে তুলে দিয়ে মুক্তকণ্ঠে বলতে পারে ‘তাহারা গিয়াছে, যাক। তাহারা তো আগুনে ঝাঁপাইয়া পড়িতে যাইতেছে না। তাহারা তাহাদের নতুন জীবনের পথে যাইতেছে। আমরা কি করিয়া তাহাদের ফিরাই। আজ না হয় কাল যাইবেই। … আমরা আমাদের পুরাতন দুনিয়ার মধ্যে সুখেস্বাচ্ছন্দ্যে বাকী দিন কাটাইয়া দিব।’ একইভাবে পুরনো মান্ধাতা আমলের বিচারিক রায় পাঠে ব্যর্থ হন জজসাহেব, দারিদ্রপীড়িত আমেনার সন্তান এবং স্বামীহত্যার দায়ভার অলক্ষে তুলে দেন তিনি সমাজেরই হাতে। অপরদিকে বিশ হাত দীর্ঘ সুড়ঙ্গ কেটে অসুস্থতার ভানকরা রাবেয়ার ঘরে অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের প্রবেশ নির্মল রূপকতারই ইঙ্গিত। সবশেষে সম্পূর্ণ এ্যাবসার্ডধর্মী আদলে রচিত হয়েও নৌকাবাহকের উজানবাহী পথচলায় পাওয়া যায় জীবনেরই গল্প। সে গল্প আকন্ঠ ব্যর্থতায় নিমগ্ন একজন মানুষের উর্ধমুখী বাহু উৎক্ষেপণ কিংবা তীরে ফেরার প্রচেষ্টার গল্প। কখনই জীবনবিমুখ বা সমাজবিমুখ ছিলেন না তিনি। চল্লিশের দশকে যখন থেকে তাঁর ছোটগল্পের যাত্রারম্ভ তখন থেকেই তিনি বাংলাদেশের ছোটগল্প সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল শিল্পী। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ নয়নচারার প্রতিটি গল্পই সমাজ-সমস্যা সংক্রান্ত। তবে সামাজিক সমস্যা কখনও ব্যক্তিক সমস্যাকে এড়িয়ে সম্ভব নয়, তাঁর গল্পগুলিতে একইসঙ্গে রয়েছে তাই ব্যক্তির অন্তর্জগতের সীমাহীন বহিঃপ্রকাশ। ‘নয়নচারা’ গল্পের ছিন্নমূল চরিত্র আমু বা ‘মৃত্যুযাত্রা’ গল্পের দুর্ভিক্ষতাড়িত গ্রামছাড়া জীবন্মৃত মানুষগুলো অথবা ‘পরাজয়’, ‘জাহাজী’, ‘খুনী’, ‘রক্ত’, ‘সেই পৃথিবী’ প্রভৃতি গল্পের চরিত্রেরা; জীবনের প্রতিনিয়ত প্রতিঘাতে বাহ্যিকভাবে হয়ত বা পর্যুদস্ত বা ম্রিয়মাণ সকলে, কিন্তু তাদের অন্তঃসলিলে বয়ে চলা কল্পনা, স্বপ্ন, অনুপ্রেরণাগুলো যখন ভাষার পেলবতায় বাঙময় হয়ে ওঠে গল্পশরীরে, প্রথানুগত্যের ভাঁজ ভেঙে পাঠকরুচিও তৎপর হয় নতুন কোনো বোধ বা অভিপ্রায়ে। একই রেশ ধরে এগিয়েছে প্রায় বিশ বছরের ব্যবধানে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ দুই তীর ও অন্যান্য গল্পএর গল্পগুলোও, এক্ষেত্রে যদিও প্রাধান্য পেয়েছে নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত-উ”চবিত্তের সামাজিক এবং মানসিক সমস্যা ও সংকট। উপরোল্লিখিত চিঠির নিম্নাংশে পুনশ্চ দিয়ে যে কথাগুলো তিনি লিখেছেন, ‘“খণ্ড চাঁদের বক্রতায়” আমি ভোল বদলিয়েচি কী? আমার লেখায় কোনো বিশিষ্ট ভোল নেই। তবে এটায় ভালো-মন্দের কথা আলাদা। তাছাড়া এখন যা লেখা হচ্ছে, একে একটা experiment বললে হয়তো ভুল হবে না।’ এক্ষেত্রে ‘ভোল বদলানো’ কিংবা experiment এই শব্দদুটো প্রথম পর্যায়ের গল্প ‘খণ্ড চাঁদের বক্রতার’ মত তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়ের একটি গল্প ‘নিস্ফল জীবন নিস্ফল যাত্রা’র ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। প্রথম গল্পটিতে রয়েছে একটি বিশেষ সামাজিক আবহ ও পরিমণ্ডল; বস্তিবাসী মানুষগুলোর বাহ্যিক আচার-আচরণে, তাদের দৈহিক বিবরণে একধরণের পরিহাস তরলতা বিরাজমান গল্পটির বয়নে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এদের জীবনের গভীরতা ক্ষীণ এবং স্থূল, অথচ পয়লাবিবির মাতৃত্বের হাহাকার কিংবা একাধিক বিবাহের অভিলাষী শেখ জব্বারের অপার প্রভুত্ব-বাসনা, বস্তির অপরাপর বাসিন্দাদের হাঙ্গামা-হট্টগোল, জুয়োর আড্ডা ইত্যকার বিশৃঙ্খল এবং ক্লিন্নকায় পরিবেশেও সামগ্রিকভাবে জীবনার্থের নূতন দ্যোতনা সৃষ্টিতে সমর্থ হয় যেন। দ্বিতীয় গল্পটিতে রয়েছে বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক-নিরীক্ষা; মৃত্যু সমাচ্ছন্ন একজন মানুষের শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার অভিলাষ জাগতেই পারে, কিন্তু মৃত্যুযাত্রী সদরুদ্দীন যেভাবে তার অসুস্থ-পঙ্গু শরীর নিয়ে পথে নেমে পড়ে এবং প্রতিটি পরিচিত জনের কাছে মাফ চেয়ে বেড়ায়, অবশেষে একই অভিলাষ নিয়ে চিরশত্রু আখলাকের মুখোমুখি দাঁড়ায় ও ক্ষমাপ্রার্থনা করে, ক্ষমা করতে পারে কি আখলাক? গল্পটির অভিনবত্ব এখানেই। বরঞ্চ সদরুদ্দিনের অত্যাশ্চর্য খেয়াল তার আচরণের অস্বাভাবিকতাকেই প্রমাণ করে দেয়; কেননা জীবনের নিস্ফল বোঝা বয়ে বয়ে শেষযাত্রাপথে পৌঁছে কোনো অনুযোগ-অনুতাপের সুযোগ থাকে না আর। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-এর অপ্রকাশিত গল্পের সংখ্যা বিশ বা ত্রিশের অধিক, ‘সওগাত’, ‘মাসিক মোহম্মদী’র পাতায় গল্পগুলি ছড়ানো-ছিটানো পাওয়া যায়, পরবর্তীতে যা অগ্রন্থিত গল্পসংকলন হিসেবে প্রকাশ করা হয়। সংকলনভুক্ত তাঁর একটি গল্পের নাম ‘না কান্দে বুবু’; এই গল্পটিতেও রয়েছে সুস্পষ্ট নিরীক্ষার ছাপ। বলাচলে এই গল্পটিতেই তিনি যথার্থভাবে বিষয় এবং প্রকরণের ‘ভোল’ বদলেছেন। বাংলা পুঁথিসাহিত্যের আদলে ‘কথকতা পাঠের’ চিরভ্যস্ত ভঙ্গির সরাসরি অনুসরণ রয়েছে গল্পটিতে; চিরদুঃখী বিধবা বুবু আর জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত তার শহর-ফেরতা সোনা ভাই আফতাব মিঞার সুখ-আনন্দ-বেদনা-বিষাদের অন্তর্গত প্রতিচ্ছায়া গল্পটির পরতে পরতে, বর্ণনায় রয়েছে দেশজ ও লোকজ শব্দের সুপরিমিত বিন্যাস। আন্তর্জাতিকমনস্ক এই লেখকের ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটিও বিশিষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, লালসালুর ইংরেজি অনুবাদ Tree Without Roots সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নিজেই করেছিলেন; বইটি বৃটেনের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ‘চ্যাটো এ্যান্ড উইনডাস’থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। পরবর্তী সময়ে চাঁদের অমাবস্যার অনুবাদ নিয়েও ভেবেছিলেন, No Amarnath নাম দিয়ে অনূদিত বইটি শেষপর্যন্ত আর প্রকাশিত হয়নি। অনুবাদ ছাড়াও সরাসরি ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চার আকাক্সক্ষা বা তীব্র বাসনা বরাবরই তিনি লালন করে গেছেন নিজের ভেতর, কিন্তু কোনো অনির্দেশ্য কারণে তাঁর ইংরেজি ভাষায় রচিত প্রায় প্রতিটি গ্রন্থই অসমাপ্ত বা অপ্রকাশিত থেকে গেছে। লালসালু প্রকাশের অব্যবহিত পরই ১৯৫০ সালে এক চিঠিতে তিনি কবি কায়সুল হককে জানান, “অক্টোবর মাসের মধ্যে আমার একটি ইংরেজি বই শেষ করিবার কথা বলিয়া আমি বর্তমানে অন্য কিছু লিখিতে পারিব বলিয়া মনে হইতেছে না।” ১৯৫৬ সালে বন্ধু ড. এ. কে. নাজমুল করিমকে এক চিঠিতে লেখেন, I am rather unhappy because I can not write. I have not been able to finish the novel in English I started in Dacca. ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রকাশক মোহাম্মদ নাসির আলীকে লেখেন, I am now working on a new novel. I am writing this in English. I may translate it into Bengali later. সবগুলো প্রচেষ্টাই অসম্পন্ন থেকে যায় শেষপর্যন্ত। অথচ উক্ত কালপরিসীমায় একের পর এক প্রকাশ পায় ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক মিলিয়ে তাঁর অন্যান্য শ্রেষ্ঠ রচনাসমুহ। তাই এ কথা বলা যায় যে ইংরেজি সাহিত্যচর্চায় যে কোনো কারণেই হোক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর অভিনিবেশ ধরে রাখতে পারেন নি, এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ যথার্থই বলেছেন যে, “কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ওয়ালীউল্লাহ্ ইংরেজিতে গল্প-উপন্যাস লিখতে গিয়ে সময় ও শক্তির অপব্যয়ই করেছেন। যে-সময় তিনি ইংরেজি রচনার পেছনে ব্যয় করেছেন সে-সময়ে মাতৃভাষার কাজ করলে আমরা তাঁর আরো মূল্যবান রচনা পেতাম, সমৃদ্ধ হতো আমাদের সাহিত্য।” আবার এভাবেও বলা যায় যে তিনি যা রচনা করেছেন (গল্প, উপন্যাস, নাটক) সংখ্যার বিচারে না গিয়ে আয়তনিক বিচারে সেসব সৃষ্টির গভীরতা অতলান্তিক। এই অতল নিষ্ঠা বাংলাসাহিত্যকে যতদূর সমৃদ্ধ করেছে, তাঁর ইংরেজি সাহিত্যচর্চার পূর্ণাঙ্গতা সেই সমৃদ্ধিকে আরও প্রসারিত করতে পারত হয়ত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র অসমাপ্ত দুটি ইংরেজি রচনা How does one cook Beans Ges The ugly Asians (ইউজেন বারডিক ও উইলিয়ম লেডারারের The ugly American গ্রন্থের প্রত্যুত্তর) অনূদিত হয়ে সম্প্রতি পাঠকের সামনে এসেছে। শিবব্রত বর্মণ অনুবাদকৃত গ্রন্থদুটির বাংলা নাম যথাক্রমে শিম কিভাবে রান্না করতে হয় এবং কদর্য এশীয়; দুটোই স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গাত্মকধর্মী রচনা; ইংরেজি ভাষার নিপুণ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রথমটিতে উপনিবেশবাদীদের চতুর কার্যকারণ ও এশীয়দের প্রতি তাদের অবজ্ঞা, লুণ্ঠন ও বঞ্চনার প্রকৃত-সত্য এবং দ্বিতীয়টিতে মার্কিন সম্রাজ্যবাদীদের চোখে এশিয়ানদের ‘আগলি’ হয়ে ওঠার প্রকৃত-কারসাজি ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় তিনি পশ্চিমি পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। উল্লেখ্য অনুবাদকৃত গ্রন্থদুটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই মূল ইংরেজি গ্রন্থ পাঠশেষে মাহমুদ শাহ কোরেশী ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-এর অপ্রকাশিত উপন্যাস দ্য আগলি এশিয়ানস’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে উপন্যাসটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এবং মন্তব্য করেন, সেখান থেকে গৃহীত উদ্ধৃতি, “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-এর ইংরেজি উপন্যাস দ্য আগলি এশিয়ানস প্রকাশিত হলে পাঠকের প্রতিক্রিয়া কি দাঁড়াবে জানি না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে, কিছুটা কালাতিক্রমণ দোষ সত্ত্বেও এ গ্রন্থ লেখকের একটা নতুন পরিচিতি তুলে ধরবে। প্রকাশিত বাংলা গল্প-উপন্যাসে ওয়ালীউল্লাহ্ সযত্নে রাজনীতি পরিহার করলেও এ গ্রন্থটি পুরোপুরি রাজনীতিনির্ভর এবং এখানে রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির আবহে নির্মিত একটি কাহিনি বা একাধিক উপকাহিনির সমাহার। পঞ্চাশের দশকের পাকিস্তানের একটি সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে এতে।” বিষয়গত আলোচনায় উপন্যাসটি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, “ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব, পাশ্চাত্যশক্তির স্বার্থপরতা ও দেশীয় ক্ষমতাশীলদের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজ থেকে চার দশকেরও বেশি সময় আগে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন এমন এক মার্কিন মিশনারীকে যিনি ধর্ম নয়, আমাদেরকে ডেমোক্র্যাসিতে ‘কনভার্ট’ করাতে চান কিন্তু তিনি এদেশের মানুষকে ভালোবাসেন না, কেননা এখানে যে কাউকে যে কোনো মূল্যে কেনা যায়, ‘একটা রেফ্রিজারেটার, একটা টেপরেকর্ডার কিংবা তাঁর ভাইপোকে আমেরিকায় পাঠানোর প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে’। এমনকি জাতীয় নির্বাচনের মতো ব্যাপারও একটা ভাঁওতাবাজি, একটা উদ্ভট খেয়াল, ‘a freak’ জনগণের আসল মতামতের প্রতিফলন নয়।” সবশেষে তিনি বলেছেন, “লেখক মধ্য-পঞ্চাশ মধ্য-ষাটের ‘জিওপলিটিক্যাল’ বাস্তবতা তাঁর উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন। এখন প্রকাশ পেলে অনেকে কৌতুহলের বশে কৌতুকভরে হয়ত এ উপন্যাস পড়বেন। কিন্তু তাতে কি সমকালে শিক্ষা গ্রহণের উপাদান কিছুই পাওয়া যাবে না? মনে তো হয় পাওয়া যাবে। কেননা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-এর প্রায় হ্যারমেটিক শিল্পবোধসম্পন্ন চৈতন্য যে একবার অন্তত আফ্রো-এশীয় মানসিকতায় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুচিন্তিত শিল্পিত প্রতিফলন নির্মাণে তৎপর হয়েছিল তার প্রমাণ ‘এখনও অপ্রকাশিত’ দ্য আগলি এশিয়ানস।” সম্প্রতি অনুবাদ না-কি মূল ইংরেজিতে রচিত সে কথা মাথায় না রেখেই উপরোল্লিখিত গ্রন্থদুটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র রচনাকর্মের অংশ হিসেবে বিবেচনায় আনা হচ্ছে । বিশিষ্ট সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ গবেষক এবং সমালোচক ড. শামসুদ্দিন চৌধুরীর মূল্যবান মতামত এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, “ওয়ালীউল্লাহ্র বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষায় এই রচনারাশি অন্যতর বিশ্লেষণ অধ্যয়ন দাবি করে। মাতৃভাষা ভিন্ন অন্যভাষায় লেখালেখির চর্চা (বিশেষ করে সৃজনশীল রচনাকে)-কে ‘এক্সোফোনি’ নামে বোঝানো হয়। বহুকাল ধরে চলে আসা এই চর্চাকে অপেক্ষাকৃত নতুন এই নামে লিটেরারি ও কালচারাল স্টাডিজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এটি এখনকার বিশ্বে ‘ট্রান্সন্যাশনাল লিটেরাচার’ এর এক ফর্ম; বহুরকম প্রণোদনা থেকে কেউ ‘এক্সোফোনিক’ লেখক হয়ে উঠতে পারে : রাজনৈতিক বিবৃতি দিতে, বিশেষ ভাষার শৈলীগত উপাদান খাপ খাওয়াতে, পরিহার করতে, অনুবাদের মধ্যে হারিয়ে যাবার ঝুঁকি এড়াতে বা বিস্তৃত পাঠক লাভ করতে। কিছু কিছু ‘এক্সোফোনিক’ লেখক অনুবাদক হয়ে থাকেন তাদের নিজের রচনাসহ। তাই ‘এক্সোফোনিক’ রচনার অনুবাদ শৈলীগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন ভাষার ‘বিপরিচিতিকরণের’ দরুণ সমস্যা তৈরি করতে পারে। এই বিবেচনা ওয়ালীউল্লাহ্-এর ইংরেজি, ফরাসি রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ করে ন্যারেটিভসমূহের প্রাসঙ্গিক ও উপযুক্ত মনে করি।” তবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হলে মূল ইংরেজিতে অপ্রকাশ্য তাঁর সকল গ্রন্থের প্রকাশ-সম্ভাবনা আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কেবল ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চাই নয়, কবিতা এবং একাধিক প্রবন্ধ রচনাতেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সুদক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়; এদের ভেতর দুটি কবিতা ‘প্রকল্প’ মাসিক সওগাত ২৫শ বর্ষ ফাল্গুন ১৩৪৯তে এবং ‘তুমি’ দ্বিমাসিক ‘মৃত্তিকা’ ২য় বর্ষ ৩য় সংখ্যা, গ্রীষ্ম ১৩৫০ তে প্রকাশিত। ‘প্রকল্প’ নামক এক স্তবক বিশিষ্ট কবিতাটিতে অত্যন্ত সংহত ভাবনায় অনুমিত এক সত্যকে তুলে ধরেছেন কবি ওয়ালীউল্লাহ্, সে সত্য মানবতাতত্ত্বের; ধ্বংসপ্রাপ্ত কিংবা লয়প্রাপ্ত পৃথিবীর শেষ কিনারায় দাঁড়িয়েও আত্মবল আর আত্মশক্তিতে বলীয়ান যে মানুষ, অক্ষয় সে, অমর সে। ‘তুমি’ কবিতাটি মূলত নারীশক্তির আবাহন; কবিতাটির অভিনবত্ব, বিচিত্র-রূপিনী নারীর উপমায় ভয়ঙ্কর যত জন্তুর ব্যবহার করেছেন তিনি; এমন কি নারীর রূপ বর্ণনাতেও মোহজ শব্দগুলি পরিহার করে গেছেন, যেমন নারীর মাথা শালিকের মাথার মতো চ্যাপ্টা, পিচ্ছিল ও কালো; নাক টিয়ার ঠোঁটের মতো বাঁকা, শক্ত আর তীক্ষ্ণ; পা বকের পায়ের মতো সরু, দীর্ঘ ও ঢ্যাঙ ঢেঙে; উটের মতো তার হাঁটা, হাতীর মতো তার বসা; হাসি-কান্না কাকাবুরা আর শিম্পাঞ্জির মতো; জিরাফের মতো তার উঁচানো গলা, কচ্ছপের মতো গুটানো স্বভাব, ছাগলের মতো উদাসীন চোখ; কিম্ভূতকিমাকার এই নারীই আবার হিংসায়-হিংস্রতায় বাঘা-হাঙ্গরের মতো; কখনো নেকড়ে কিংবা চিতার মতো সীমাহীন শক্তিমত্তায় তীব্র; অথচ চিরকালীন মুখরতায় ব্রাজিলদেশের হাউলার-বানরের মতো অধীর দুর্দান্ত সে। এভাবেই কোনো নতজানু প্রেমিক পুরুষ কিংবা লীলাময়ী নারীর দৃষ্টিকোণ ব্যবহার থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন কবি, কেননা অস্তিত্ত্ব কিংবা নারীত্ব রক্ষার প্রশ্নে এহেন বিবিধ রূপ লালনে এবং ধারণে বরাবরই সক্ষম নারী। এছাড়া পরিবেশ ও বাস্তবতার নিরিখে নারী-নিগ্রহের বার্তা পরিবেশনেও যথার্থ তাঁর ভাষা, আদিকাল থেকে বর্তমানের আধুনিক যুগ পর্যন্ত নারীমুক্তির প্রেক্ষাপটখানি পরিস্কার সেখানে; সভ্যতা মানবমুক্তির কথা বলে, অথচ নারী কখনোই তার অশোভন পরিবেশ থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেনি। কবির শপথ তাই নারীকে তার নিজস্ব সত্তায় নিজস্ব আদলে প্রতিস্থাপিত করার, “তোমাকে আবৃত করার একটা প্রচণ্ড প্রয়াস এ-সভ্যতা …/ যা আসলে অসভ্যতা।/ (হায় তোমাকে বুঝি বাঁচানো গেলো না।)/ কিন্তু ভয় পেয়ো না,/ তোমাকে আমি প্রকাশ করবোই।/ শান্তভাবে না পারি, বিপ্লব ক’রে প্রকাশ করবো।/ তোমার সত্যিকার মূর্তি আমি দেখতে চাই এবং সবাইকে দেখাতে চাই,/ যতোই তুমি কিম্ভূতকিমাকার হও না কেন।” নারীবন্দনার এ এক ভিন্নতর প্রয়াস!
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-এর প্রবন্ধের সংখ্যা একাধিক, একজন জ্ঞানবুদ্ধ পরিশ্রমী পাঠক ছিলেন তিনি। তাঁর পড়াশোনা ও জ্ঞানার্জনের পরিধি সম্পর্কে সৈয়দ আবুল মকসুদের দেয়া তথ্য এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, “প্রচুর পড়াশোনা করতেন। শুধু সাহিত্যের বই নয় রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মতত্ব, শিল্পতত্ব, দর্শন, মনোবিজ্ঞান এমন কি বিজ্ঞানের বইপত্র পর্যন্ত সমানে গিলতেন। অল্প বয়সেই ক্যামু, সার্তের দর্শনের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। নিতান্ত স্বল্পভাষী ছিলেন ব’লে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির পরিধি প্রায়শই অন্যের কাছে অজ্ঞাত থাকতো।” এই অজ্ঞাত এবং ‘গভীর জ্ঞান-ধারণ-ক্ষমতা’র সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে ‘খেয়া’ প্রবন্ধটিতে। আমরা সাধারণ বুদ্ধিতে ‘খেয়া’ পারাপারের কথা বুঝি, কিন্তু সভ্যতার পারাপার সম্পর্কে সেভাবে ভাবি না বিশেষ; লেখক ভেবেছেন, এক সভ্যতার চূড়ান্তভূমি অতিক্রান্ত অপেক্ষমান মানুষের নূতন সভ্যতার তীরে পৌঁছুনোর দিকনির্দেশনা খুঁজেছেন তিনি। আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার কথা জানি, কিন্তু সেই ধ্বংসযজ্ঞে দাঁড়িয়ে নূতন আরেক সভ্যতার সূচনা ও বিকাশ নিয়ে মাথা ঘামাই না তেমন; অথচ সভ্যতার ধর্মই বিনাশের, একইসঙ্গে সৃষ্টির। সভ্যতাকে তিনি তিনটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করার প্রয়াস রেখেছেন। এক. সভ্যতার যৌবন-লগ্ন, দুই. সভ্যতার সূচনা-লগ্ন, তিন. সভ্যতার প্রান্তিক-লগ্ন। মানবসভ্যতায় এই তিন লগ্নই অন্তর্ভুক্তির বিষয়; লেখকের ভাষায় সৌভাগ্যবান তারাই ‘যারা কোনো সভ্যতার যৌবনে জন্মগ্রহণ করে’, কেননা সেখানে চলমান বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলোকে ধারণ ও লালন করার সুযোগ থাকে; আর যারা সভ্যতার সূচনা-লগ্নে জন্মগ্রহণ করে, তারা জানেনা, উপলব্ধিও করতে পারে না অনাগত সভ্যতা তাদের জন্য কোন্ রূপ-রস-রং বা কোন্ উপযুক্ততা বহন করতে চলেছে আর আমরা যারা সভ্যতার প্রান্তিক লগ্নের মানুষ, ‘বর্তমানে খেয়া-পারাপার হচ্ছি’, আমাদের সামনে অপরিসীম দায়বদ্ধতা। আমাদেরই রয়েছে সেই বিশেষ অন্তর্তাগিদ পুরনো জরাজীর্ণ মতবাদগুলোকে সাপের খোলসের মতো বদলে ফেলে নূতন চিন্তাসূত্র আবিষ্কার করার। পুরনো মতবাদগুলো কী? যেমন মানবধর্ম, মানবতা বা মনুষ্যত্ববোধ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত বর্তমান পৃথিবীর মানুষ; culture Avi civilization-এর জোড় মেলাতে দিশেহারা জ্ঞানবুদ্ধ মতবাদীরা; নূতন সভ্যতার যাত্রা কী এসব সমস্যার সমাধান থেকেই শুরু হবে? না-কি ঘটবে মানুষের চিন্তাধারা বা attitudeগত পরিবর্তন? লেখক তাঁর নিজস্ব মতপ্রদানে হযরত মুহম্মদ এবং কার্লমার্কসকে শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী হিসেবে স্বীকার করলেও দৃঢ়তার সঙ্গে নূতন কোনো আশার বাণী উচ্চারণ করেন নি। বরঞ্চ T S Eliot-এর মতো আস্তিক্যবাদে বাধ্যতামূলক আস্থা রেখেই (আমাদের অবচেতনা বরাবর আস্তিক, আস্তিক এ-হেতুতে যে আমরা অসহায়, যত শক্তি যত জ্ঞানথাকুক না আমাদের) অনাস্থা প্রদান করেছেন প্রাক্তন কবি Francis Thompson-এর mysticism বিষয়ক বিগত ভাবনাগুলোতে, World invisible, we view thee,/ O world intangible, we touch thee,/ O World unknowable, we clutch thee! সবশেষে সভ্যতার নূতন ভিত্তিভূমি গঠনে বিশ শতকের দুই বিখ্যাত সমাজবাদী লেখক এবং চিন্তক V F Calverton S D Schmalhausen প্রবর্তিত সূত্র থেকে Dualism I Pretense শব্দ দুটো বাদ দিতে চেয়েছেন তিনি; তাঁর ভাষায় “এই GB Dualism I Pretese-কে ধ্বংস না করা অবধি মানুষের কোনো শান্তি নেই : যা সৃষ্টি করো না কেন, নতুন সভ্যতায় নতুন মশাল নিয়ে এসো না কেন, বারেবারে ইতিহাস সেই একই কথা বলবে, সেই একই কথা বলবে।” কিছুটা হতাশা এবং দোদুল্যমানতার আভাস থাকলেও ‘সভ্যতা’ প্রসঙ্গে নূতন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ প্রবন্ধটিতে স্পষ্ট। শিল্পকলা কিংবা চিত্রকলা নিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র আগ্রহ কিংবা মেধার প্রসঙ্গটি আজ আর অনবদিত নেই; শিল্পী জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে ঘনিষ্টতা, আশৈশব চিত্রকলার চর্চা, কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অঙ্কিত চিত্রের প্রকাশ, নিজের বই-এর প্রচ্ছদপট অঙ্কন, প্যারিসে একটি চিত্র-প্রদর্শনীর আকাঙ্ক্ষা এবং নিয়মিতভাবে চিত্রসমালোচনা লেখা, এসব তথ্য থেকে সাহিত্যের মতো শিল্পকলার প্রতিও তাঁর অনুরাগের পরিচয় মেলে, পাশাপাশি একজন মেধাবী এবং কট্টর চিত্র সমালোচক হিসেবেও তাঁকে আবিষ্কার করা যায়। করাচীর ডন পত্রিকায় প্রকাশিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সম্পর্কিত চিত্রসমালোচনা Joynul Abedin : A victim of Conflicting Ideas যথেষ্ট বিতর্কেরও সৃষ্টি করে, প্রফেসর মাহমুদ শাহ কোরেশীর দেয়া তথ্যানুসারে “কোয়ার্টারলি পাকিস্তান”-এর সম্পাদক এস, আমজাদ আলী প্রকাশ করলেন এর প্রতিবাদ প্রবন্ধঃ ‘জয়নুল আবেদীন-এ ভিক্টিম অব কনফিউজড্ ক্রিটিসিজম’। ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর জবাবে ‘জয়নুল আবেদীন-এ ভিকটিম অব ফ্রাংক ক্রিটিসিজিম’ লেখেন। কিন্তু প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিলো কিনা জানা যায় নি। অ্যান্ মারীর ধারণা, এটি আসলে প্রেরিতই হয় নি।” তাঁর “অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্ট এক্সিবিশন” প্রবন্ধটিতেও রয়েছে কড়া ‘ক্রিটিসিজম’-এর প্রকাশ, শিল্পকলার বিষয়টিকে তিনি এক্ষেত্রে রুচি, মনন এবং মেধা দিয়ে বিচার করার অভিপ্রায় রেখেছেন। রুচির প্রশ্নটি আসে তখনই যখন অতি সস্তা, রঙচঙে, যৌন আবেদনময়ী নারীদেহকেই বড় করে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়; এই বিচারে হেমেন মজুমদারের চিত্রগুলি তাঁর কাছে মনে হয়েছে ‘অসহ্য’, জে পি গাঙ্গুলি, রমেন চক্রবর্তী কিংবা অতুল বোসের চিত্রগুলিতেও তেমন আকর্ষণ বোধ করেননি তিনি, প্রিয়প্রসাদ গুপ্ত বা অরুণ মিত্রের চিত্রগুলিকেও তাঁর কাছে মনে হয়েছে গতানুগতিক এবং অনুকরণদোষে দুষ্ট। তবে অপছন্দের তালিকা মোটামুটি দীর্ঘ মনে হলেও তেল রং, জল রং, পোট্রেট আর স্থিরচিত্র মিলিয়ে প্রায় ত্রিশাধিক চিত্রের মাঝে এক্সজিবিশনের অর্ধাংশ চিত্রই আকৃষ্ট করতে পেরেছিল তাঁকে, মিসেস সাস্ ব্রুনার ও তাঁর মেয়ে এলিজাবেথ ব্রুনারের ‘ত্রিমূর্তি’, ‘শিল্পী’; যামিনী রায়ের ‘বাপ ও মেয়ে’, ‘গান্ধী’; দিলীপ দাশগুপ্তের ‘মালয়বাসী’, মুরলী ধর তালির ‘আমার মা’; সুশীল সেনের ‘আমার প্রতিবেশী’; সফিউদ্দিন আহমদের ‘পারাবত’ (সভাপতির স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত); আনোয়ারুল হকের ‘হিজ্লা হতে ময়ূরাক্ষী’; কানোয়ালের ‘চিতোর দূর্গ’, ‘তিব্বতের মৃতবাহক’, ‘উদয়পুর বাজার’, ‘খড় সংগ্রহকারী’; পল রাজের ‘যাত্রা’ (জলচিত্রে প্রথম স্থান অধিকৃত); প্রিয়প্রসাদ গুপ্তের ‘সম্রাট আলমগীর’ প্রভূতি চিত্রের সংহত কিন্তু মননশীল বিশ্লেষণ দিয়েছেন তিনি। একজন মেধাবী দর্শক হিসেবে মুগ্ধতার ভাবপ্রকাশে তাঁর ভাষার ব্যবহার উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরার মতোঃ যেমন যামিনী রায়ের ‘গান্ধী’ ছবিটি নিয়ে মন্তব্য, ‘এককথায় : সে-ছবির পানে চেয়ে গান্ধীর কর্মজীবন যেন পাঠ করা যায়’; সুশীল সেনের ‘আমার প্রতিবেশী’ ছবিটিতে নতুনত্বের প্রকাশ ভেবেছেন যেভাবে, ‘ছবিই কথা কয় যে আলিশা ধরে দণ্ডায়মানা মেয়ে দুটি শিল্পীর প্রতিবেশী, নিকটের দেয়ালটি অত্যন্ত Suggestive’; সফিউদ্দীন আহমদের নিসর্গমূলক স্থিরচিত্রগুলি নিয়ে মুগ্ধ নিবেদন, ‘গোটা দৃশ্য আত্মগত করে নিয়ে বিশিষ্ট ভঙ্গিতে তা প্রকাশ করেন তিনি, অথচ সে-প্রকাশ অতি আস্তে হয় বলে আর বিবরণবর্জিত বলে তা চোখে না-ঠেকে অন্তরে গিয়ে পৌঁছে’; পল রাজের ‘যাত্রা’ ছবিটির গভীরতর মর্মোদ্ধারেও রয়েছে ভাবগ্রহণের সূক্ষ্মতা, ‘যাত্রার পথে অনেক দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়, দৃষ্টিগোচর হলেও তেমন স্পষ্টভাবে হয় না; এখানে বলদটানা গাড়িটি যে চলেছে তার ঝাঁকুনিও যেন অনুভূত হয়, বলদের গলার ঘন্টিও যেন শোনা যায়, এটাই যাত্রা চিত্রটির চমৎকারিত্ব’; সবশেষে প্রিয়প্রসাদ গুপ্তর ‘সম্রাট আলমগীর’ ছবিটিতে সম্রাটকে উপস্থাপনের যে বিবরণ, সেখানেও ঘটেছে শিল্পকলার গূঢ়তা এবং নান্দনিকতা সম্বন্ধে তাঁর স্ব”ছ এবং নিবিড় ধারণার প্রকাশ। পাশাপাশি একজন গ্রন্থসমালোচক হিসেবেও সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, তাঁর সন্ধানপ্রাপ্ত গ্রন্থসমালোচনামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা সবমিলিয়ে তিনটি; English Episode By Charls Poulsen. Progress Publishing Company Ltd. London; Time Must Have a Stop By Aldous Huxley. Chatto & Windus, London Ges Tales from Gogol. Translated by Rosa Portnova. Sylvan press. 10/6.d. প্রথম দুটি গ্রন্থের পাঠ এবং সমালোচনা যুক্তভাবে করেছেন তিনি, প্রথমাংশটি ইংলিশ লেখক চার্লস পোলসেনের (১৯১১-২০০১) উপন্যাস ‘ইংলিশ এপিসোড’ সম্পর্কিত; ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণতই ইংল্যান্ডের ১৩৮১ সালের কৃষক-বিদ্রোহ নিয়ে লেখা। ইংরেজ ইতিহাসের ক্ষণস্থায়ী অথচ বিশাল এই বিদ্রোহ, ‘যাকে ওয়াট টাইলারের বিদ্রোহ বা গ্রেট রইজিং’ নামেও ডাকা হয়। ইংল্যান্ডের বুকে অনুষ্ঠিত ১৩৪৮ সালের মহামড়ক, পরবর্তী বছরেই রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের কৃষকদের সীমাবদ্ধ মজুরী সম্পর্কিত Ordinance of Labourers আইন পাশ এবং কয়েক বছরের ব্যবধানে ১৩৫১ সালে Statute of Labourers সম্পর্কিত আরও কয়েকটি আইন পাশ, একইসঙ্গে সকলের ওপর পোল ট্যাক্স বসানো এই মহাবিদ্রোহের কারণ। এই বিদ্রোহের যিনি প্রথম নায়ক তার নাম ওয়াইক্লিফ, পেশায় একজন পাদ্রী, পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশেষ ধর্মীয় ব্যাখা নিয়ে তিনি নিপীড়িত কৃষক-মজুরের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন, সমর্থন ও প্রচারকার্য নিয়ে জন্ বল্ নামে আরেক পাদ্রী তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান। এভাবেই তাঁরা জনসাধারণের মধ্যে জাগালেন ধর্ম নিয়ে, শ্রেণী বিভেদ নিয়ে নূতন নূতন প্রশ্নের জোয়ার। অতঃপর প্রাবন্ধিকের ভাষায়, “ধর্মের রাজত্বের দিনে যখন ধার্মিকদের ওপর জনসাধারণের আস্থা একবার ভাঙ্গতে পারলো, তখন যারা তাদেরকে নিপীড়ন করছে, বঞ্চিত রাখছে নিষ্ঠুরভাবে, তাদের বিরুদ্ধে অন্তরের বিদ্রোহকে আর ঠেকিয়ে রাখা গেলো না। গ্রেট কোম্পানী নামে এক গুপ্ত দল গড়ে উঠলো ভূমিদাস মজুরদের মুক্তিকামনায়। গ্রামে গ্রামে উদ্দেশ্য প্রচারিত হোলো, একটা দিন নির্দিষ্ট হোলো বিদ্রোহ ঘোষণার। যথাদিনে গ্রামে গ্রামে দেশ জুড়ে কৃষকরা বিদ্রোহ করে লন্ডন অভিমুখে যাত্রা করলে বালক রাজা রিচার্ডের সঙ্গে দেখা করে স্বাধীনতা অর্জন করবার জন্য। রাজার প্রতি তাদের যেমন অটল বিশ্বাস তেমনি তাদের ঘৃণা রাজ-পরিষদের সভ্যদের প্রতি। গভীরতম বেদনার কথা যেটা সেটা হোলো এই যে তারা সে-রাজার দ্বারাই নির্মমভাবে প্রতারিত হোলো। তাদের স্বপ্ন তো ধূলিসাৎ হোলোই, সমগ্র দেশময় তারা কচুকাটা হোলো।” একমাসেরও কম সময় স্থায়ী হওয়া ইংরেজ ইতিহাসের মহান এই বিদ্রোহ পোলসেনের রচনায় জীবন্ত ধরা দিয়েছে যেন, ছাড়িয়ে গিয়েছে তা ফরাসি ঐতিহাসিক Jean Froissart’s Chronicles প্রদত্ত তত্ত্বীয় বিবরণসমূহ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ উপন্যাসটির তেমন সমালোচনা করেন নি, বরঞ্চ প্রশংসাই করেছেন। দ্বিতীয় অংশের আলোচিত উপন্যাস অলডাস হাকসলির (১৮৯৪-১৯৬৩) ‘টাইম মাস্ট হ্যাভ এ স্টপ’; ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসের মুখ্য বিষয় শান্তি-সুখ-আনন্দ, যার অন্বেষণ এবং অনুধাবনে ‘যুদ্ধক্লিষ্ট ঘুণধরা সভ্যতায়’ বীতশ্রদ্ধ হাকসলি ভিন্নভাবে নিজস্ব মতাবাদ এবং বিশ্বাসকে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সেবাস্টিয়ান বার্নাক একজন তরুণ কবি, যার জীবনে একের পর এক ঘটেছে ‘হেডোনিস্টিক’ চাচা ইউস্টেস, বিধবা প্রেমিকা ভেরোনিকা, ইউস্টেসের আত্মা নামানোয় পারদর্শী বৃদ্ধ অন্ধ শ্বাশুড়ি মিসেস গ্যাম্বল ও অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী বইবিক্রেতা ব্রুনোর বিচিত্রতর সংস্পর্শ এবং প্রভাব। পরিশেষে ধনী চাচা ইউসটেসের (যিনি অকস্মাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন) ভোগবাদ বা নাস্তিক্যবাদ এবং পরবর্তী জীবনে ব্যবসায়ী ব্রুনোর অধ্যাত্মবাদ, দুইয়ের বৈপরীত্য সেবাস্টিয়ানের ভেতরে উচ্চতর অন্য এক জীবনদর্শনের উদ্ঘাটন ঘটায়। হাকসলির ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ Perennial Philosophy-তেও আধ্যাত্মিকশক্তি এবং বিপরীতে যাবতীয় অসংসক্তিকেই জীবনযাপনের সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে চিহ্নিতকরণের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ হাকসলির এই জীবনদর্শনকে সমর্থন করেননি, কড়া সমালোচকের ভাষায় লিখেছেন; “হাকসলি অন্ধভাবে মানুষের মুক্তি কামনা করেছেন। যিনি নিজেকে দুনিয়ার সব স্রোত হতে বিচ্ছিন্ন রেখে অবাস্তব উচ্চ শিখরে নিঃসঙ্গ করে রেখেছেন, তাঁর কাছে মানুষের জীবনের তুচ্ছ ঘটনা, হাস্যকর অভ্যাস, মুদ্রাদোষ, কামনা ও ভোগ, স্বার্থের প্রয়োজনে প্রেম ও মমতা ইত্যাদি কুৎসিত ঠেকতে পারে, মধ্যবিত্ত সমাজের বীভৎসতায় তিনি মর্মাহত হতে পারেন, এ নিয়ে কৌতুকও করতে পারেন, কিন্তু তাদেরকে সত্য পথ বাতলে দেওয়া তাঁর কাজ নয়।” সময়কে থামিয়ে দেয়া বা অনন্তকালের মধ্যে বিসর্জন দেবার জন্য হাকসলির আবেদনকে এভাবেই ভৎর্সনা জানিয়ে সবশেষে মন্তব্য করেছেন তিনি, “তাঁর সমাজকে তিনি চিনেছিলেন ভালো, এবং তার বর্ণনা তাঁর লেখায় এমন নিখুঁত ফোটে যে চমকপ্রদ, কিন্তু মৃতবৎসা মায়ের অন্যের সন্তানপ্রীতি, মানুষের আবেগ ইত্যাদির প্রতি তাঁর বিরূপতার অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। ভুলত্রুটিতে সৃষ্ট মানুষের প্রতি যাঁর মমতা নেই, তাঁর পক্ষে মানুষের মঙ্গল কামনা করা নিরাপদ নয়।” আসলে হাকসলির এই গ্রন্থটি নিয়ে যথেষ্ট বিরূপ সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছিল তৎকালীন সময়েই, প্রাবন্ধিকের মন্তব্যসমুহেও সেই নিঃসংশয়তারই প্রমাণ মেলে। তৃতীয় গ্রন্থটির নাম ‘টেলস্ ফ্রম গগল্’, রোযা পর্টনোভা অনূদিত গগলের ছোটগল্পের সংকলন। রুশ সাহিত্যে নিকোলাই ভার্সিলয়িত্রভিচ গগল্ (১৮০৯-১৮৫২)-এর অবস্থান নিয়ে আজ আর কোনো দ্বিধা নেই, বিশেষত একজন শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার হিসেবে। তবে ১৯৪৫ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যখন গগল্কে নিয়ে ভাবতে বসলেন তখন পর্যন্ত মৃত গগল্ নিষ্ঠুর দারিদ্রতায়, সামাজিক অপব্যবস্থায়, পারিপার্শ্বিকের রূঢ় অভিজ্ঞতায় আগাগোড়া বিপর্যস্ত, পরাজিত এবং বাস্তব-পলাতক হিসেবে চিহ্নিত একজন মানুষ। এমনকি জন্মভূমি ইউক্রেন, সেখানকার সূর্যালোকারোপিত প্রকৃতি, উদ্ভাসিত বনপ্রান্তর, অশিক্ষা-কুসংস্কারা”ছন্ন গেঁয়ো মানুষগুলিকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন-কল্পনাগুলো ভাগ্যান্বেষণের দায়ে পিটার্সবুর্গের জরাজীর্ণ নগর-অভ্যস্ততায় প্রতিমুহূর্তে পদদলিত হতে হতে একসময় নিজের মন থেকে সুস্থ-নিয়মিত সাহিত্যিক আদর্শকে জলাঞ্জলি পর্যন্ত দিয়েছেন। প্রবন্ধটিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যে সাহিত্যিক গগল্-এর ছবি এঁকেছেন “সে-সাহিত্যে মধ্যবিত্ত সমাজের ভেতরের অসাড় দৈন্যতা ও কুশ্রীতা নগ্নভাবে প্রকাশ পেলো। সমাজকে ভালোবেসে ও তার উন্নতি কামনায় তিনি তাকে প্রকাশ করেননি, ঘৃণায় ও প্রতিঘাতের বাসনায় করেছেন। ঘৃণায়, সৌন্দর্যের তৃষ্ণায় ও আদর্শের তাগিদে সৃষ্ট সাহিত্যের পেছনে কোন সচেতনতা ছিলো না, কিন্তু যখন তিনি সচেতন হলেন তখনই শিল্পী গগলের মৃত্যু হলো, চেতনায় ও অজ্ঞানতায় যে-সাহিত্য তিনি করতে গেছেন এরপর তা সস্তা ও নীচু স্তরের হয়েছে।” কিন্তু বর্তমানের সমালোচকদের পরিভাষা গগল্কে নিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র এই নঞর্থক মূল্যায়ন সমর্থন করে না। বরঞ্চ যুগপরিক্রমায় গগল্ নিত্য-নূতন অভিনিবেশে আবিষ্কৃত হয়েছেন, হয়ে চলেছেন। তাঁর হতদরিদ্র জীবনে সমাজ থেকে পাওয়া অবজ্ঞা, নিষ্ঠুরতাগুলো যেভাবে তাঁর সৌন্দর্যবোধগুলোকে কদাকার আকৃতি দিয়েছে, নির্মিত চরিত্রগুলো পাঠকের কাছে ধরা দিয়েছে বিসদৃশ-অদ্ভুত-উদ্ভট আচার-আচরণকারী হিসেবে; বর্তমানের সমালোচকেরা গগল্-এর এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই খুঁজে বের করেছেন নূতনধারার এক সাহিত্যিক কৌশল, যা defamiliarization হিসেবে স্বীকৃত। অর্থাৎ অদ্ভূতের আবরণে বাস্তবতার উল্টোরকম প্রকাশ; ‘বীভৎস সমাজের বাস্তবতা থেকে’ ঠিক ‘পালানোর চেষ্টা’ হয়ত নয়, বরঞ্চ ‘ফিরে দাঁড়ান, বাস্তবকে না মেনে সমাজকে রূঢ়ভাবে আঘাত করার’ ভিন্ন রকমের অভিব্যক্তি। তাঁর বিশ্বখ্যাত ছোটগল্পগুলি; “The Nose, Viy, The Overcoat, The Tale of How Ivan Ivonovich Quarreled With Ivan Nikiforovich, Nevsky Prospekt, Diary of a Madman” প্রভৃতিতে প্রচলিত রীতিপ্রথাগুলো গুঁড়িয়ে জীবনের অর্থহীনতা বা অসমঞ্জস্যতার প্রকাশে যে পদ্ধতিকে অবলম্বন করেছেন তিনি, পরাবস্তু, উদ্ভট, প্রতীতি বা অভিব্যক্তিবাদের মতো আধুনিক তত্ত্বগুলোর সৃষ্টিও হয়ত এখান থেকেই। সমালোচক অহফৎবু ইবষু-র একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য এক্ষেত্রে, Gogol’s work influenced the emergence of Gothic romance and served as a forerunner for absurdism and impressionism.সম্প্রতি ওয়ালীউল্লাহ্র সহধর্মিণী অ্যান-মারি ওয়ালীউল্লাহ্ প্রকাশিত একটি গ্রন্থ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্; মাই হাজব্যান্ড অ্যাজ আই স’ হিম (২০২২) পাঠকমহলের সামনে এসেছে। সামসাদ মূর্তজা সম্পাদিত গ্রন্থটিতে একজন সহধর্মিণী হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্কে ঘিরে তাঁর অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও সুচারু বিশ্লেষণের পাশাপাশি রয়েছে মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্রসমুহ। লেখক, পাঠক, চিত্রসমালোচক যাই হোন না কেন, সবমিলিয়ে স্বামীর রাজনৈতিক দর্শন, দেশ-কাল-মানুষ সম্পর্কে সচেতনতাবোধ অর্থাৎ সর্বাঙ্গীণভাবে তাঁর মতাদর্শজনিত সুস্পষ্ট ধারণা মেলে গ্রন্থটির স্মৃতিচারণমূলক মনোগ্রাহী বর্ণনায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র চিন্তা-চেতনা, ব্যক্তিগত জীবন-যাপন বা রুচি-অভিরুচি সম্পর্কিত বিবিধ আলাপচারিতা গত কয়েক দশকে সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দ আকরম হোসেন প্রণীত গ্রন্থদুটি ছাড়াও অন্যান্য গ্রন্থ এবং দৈনিক পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতার বিভিন্ন প্রবন্ধে ঘনিষ্ঠজনেরা প্রকাশ করেছেন; এঁদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, রশীদ করিম, আনা ইসলাম, প্রফেসর মাহমুদ শাহ্ কোরেশী প্রমুখ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওয়ালীউল্লাহ্র অন্তর্তাগিদ এবং অন্তর্দাহ এবং একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার মতো বিদেশী সংগঠন এবং বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপন প্রসঙ্গেও সৈয়দ আবুল মকসুদ সংকলিত পত্রাবলি থেকে পাঠক অবগত। ১৯ মে ১৯৭১ সালে প্রফেসর কোরেশীকে লেখা একটি পত্রে তাঁর উদ্বেগের প্রকাশ ঘটেছে এভাবেঃ “কিছু ঘুরে আপনার তিন তারিখের চিঠি এইমাত্র হাতে এসেছে। দেরীর কারণ ইউনেস্কোতে আমি আর নেই, আগের বাড়িও ছেড়েছি। কন্ট্রাক্ট শেষ হবার পর দেশে ফিরবার আগে কিছু ছুটি নিয়েছিলাম, তারপর পশ্চিমীদের আক্রমণ শুরু হলো। ফিরতে হলে পশ্চিমে (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে) ফিরতে হবে, কিন্তু এমাতবস্থায় না ফেরাই মনস্থির করেছি। ফেরা অসম্ভব। চাকরী হয়তো থাকবে না। কিন্তু এ ভাবে কী চাকরী করা কখনো সম্ভব? … ওখানে আমরা কিছু একটা না করতে পারলে দুনিয়ার উদাসীনভাব স্বাভাবিক। আমি বিশেষ করে খবরশূন্য বোধ করছি। কিছু খবর পাঠান। কিছু যোগাযোগ দরকার। …” দেশ নিয়ে তাঁর এহেন উদ্বিগ্নতা, ব্যাকুলতা এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার নানাবিধ মানসিক ও উ”চরক্তচাপ জনিত কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একাত্তরের দশই অক্টোবর মারা যান তিনি। সে সময়েও মিসেস ওয়ালীউল্লাহ্ সার্বক্ষকিণকভাবে তাঁর পাশে ছিলেন। অর্থাৎ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র মানস এবং সর্বাঙ্গীণ লেখকসত্তায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকেছেন অ্যান মারি, স্বামী কখন কোথায় কীভাবে কোন রচনাটি সম্পন্ন করেছেন, এমনকি রচনাকর্মের ভাষা, আঙ্গিক, উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা সম্পর্কেও যাবতীয় তথ্যের সঞ্চালন ঘটিয়েছেন তিনি। গ্রন্থটির শেষপর্যায়ে অনগ্রসর মুসলমান বাঙালি সমাজ নিয়ে ওয়ালীউল্লাহ্র মতাদর্শের দৃঢ়তাকেই সর্বোচ্চ রাখতে দেখা যায় তাঁকে। বলাবাহুল্য যে, বিশিষ্ট বন্ধুজনদেরকে লেখা চিঠিতে ‘সমাজের পিছিয়ে পড়া চৌদ্দআনাকে নিয়ে সাহিত্য রচনায় নিয়োজিত থাকার পরিকল্পনা’ এ ব্যাপারেও কম-বেশি অবহিত পাঠকসমাজ। I want to write মুসলমান সমাজ নিয়ে আফসারউদ্দিনকে লেখা চিঠির এই উদ্ধৃতি প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লিখিত এবং আলোচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে আরও যেটুকু সংযুক্ত করা যায়; ‘স্বপ্নের অধ্যায়’ নামক সুদীর্ঘ একটি গল্প রয়েছে তাঁর, অগ্রন্থিত এই গল্পটিতে বাঙালি মুসলমানের আত্ম-পরিচয়ের দিকটিকে প্রধান চরিত্র মালেকার স্বপ্ন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে অপূর্ব নৈপুণ্যতায় পরিবেশন করেছেন তিনিঃ “মানুষের পুনর্জন্ম হয় না, কিন্তু জাতির হয়। আমরা মরে গিয়েছিলাম ভারতে, মিশরে, আরবে, আলবেনিয়াতে, পৃথিবীর সর্বত্র। আমরা হয়ত আবার নতুনভাবে জন্মলাভ করেছি, কিন্তু কেউ হয়ত সে-কথা জানে না। জানলেও বিশ্বাস করে না। … যে একটা শক্তি আমাদের ছিলো সে-শক্তি আজ নষ্ট গেছে। যে শক্তির বলে সারা দুনিয়ায় আমাদের মাথা উন্নত ছিলো, সারা দুনিয়ায় আমরা এক ছিলাম। আজ এ-কথা ঠিক যে মিশর দেশের মুসলমান বাংলাদেশের মুসলমানের কথা কিছুই ভাবে না, আমরা ধ্বংস হয়ে গেলেও ওদের সামান্য দুঃখ হবে না, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ভেঙে গেছে বলেই আমরা এ-কথা মেনে নেই, এর বাইরে আর কিছু কল্পনা করতে পারি না। … তাছাড়া সে-শক্তিতে তোমার কী বিশ্বাস হবে যখন তুমি অগণ্য মুসলমান ভিক্ষুকের পানে তাকাবে, পর্দার অন্তরালে রুগণ ফ্যাকাশে জীবজাতীয় নারীদের পানে তাকাবে, চাষা, গাড়োয়ান, বিড়িওয়ালা, লম্পট, জোচ্চোর এবং কুৎসিত চেহারার অন্তঃসারশূন্য কাটমোল্লাদের পানে তাকাবে? বিশ্বাস-তো দূরের কথা, লোকে শুনে হাসবে। কিন্তু তবু সত্য। এবং সে-সত্যের শক্তি নয় বটে তবে তার স্বপ্ন আমার মধ্যে।” এছাড়াও ‘দুই তীর’, ‘পাগড়ি’, ‘স্তন’ প্রভৃতি গল্পে আমাদের সমাজে মুসলিম আভিজাত্যের দৈন্যতা ও কৃত্রিমতার দিকগুলো প্রকট হয়ে উঠেছে। তবে একথা মানতেই হয় যে, বাঙালি মুসলমানের পিছিয়ে পড়া অবস্থানের এসব টুকরো চিত্র কখনোই তাঁর সাহিত্যের মূল আধার হিসেবে কেন্দ্রীভূত হয়নি।বক্ষ্যমান নিবন্ধটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে সর্বাঙ্গীণভাবে জানার এবং বোঝার ক্ষুদ্র প্রয়াসমাত্র। তিনটি উপন্যাস, চারটি নাটক আর পঞ্চাশোর্ধ ছোটোগল্প নিয়ে তাঁর যে সাহিত্যভুবন, বাংলাদেশের সাহিত্যধারায় শিল্পনিরীক্ষা বা শিল্পসমীক্ষার প্রশ্নে সে-সৃষ্টির গভীরতা অনন্ত। তবুও একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক তাঁর অনালোকিত, অনাবিষ্কৃত সৃষ্টিশক্তি নিয়ে নূতনভাবে মূল্যায়নের সুযোগ পেতেই পারেন; শতবর্ষ পেরিয়ে বিশ্বমানদ-ে নূতনচেতনায় উপস্থাপিতও হতে পারেন, কিন্তু সে-প্রচেষ্টা কখনোই তাঁর মূল সৃষ্টিসত্তাকে ছাপিয়ে নয়; আগামী প্রজন্মের বোদ্ধা পাঠক এবং গবেষকের কাছে এইটুকুই প্রত্যাশা।
Discussion about this post