“যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যে দেশের নীল অম্বরে মন মেলেছে পাখা
সারাটি জনম যে মাটির টানে অস্ত্র ধরি
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”
—গোবিন্দ হালদার
প্রাককথন :
প্রাচীন পুঁথিপুস্তক এবং আধুনিক যুক্তি-তর্কের বিচারে বাঙলা কবিতার বয়স সহস্রাধিক। সুদীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক কিংবা বৈশ্বিক উত্থান-পতনে রয়েছে এর প্রাগাঢ় যোগসূত্র— যা বাঙলা কবিতাকে করেছে ঋদ্ধ, স্বতন্ত্র, এক ভিন্নমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের সত্তাধিকারী। বাঙলা কবিতা বাঙালির পরম সম্পদ— মায়া, মমতা, আবেগ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা কিংবা উপলব্ধির শ্রেষ্ঠাধার। বাঙলা কবিতা তার সুবিশাল বক্ষে যেমন ধারণ করে আছে জাতির ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যমালা তেমনি সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ। মুক্তিযুদ্ধ এমনি একটি উজ্জ্বল অনুষঙ্গ— যা বাঙলা কবিতাকে করেছে বৈচিত্র্য ও ব্যঞ্জনাময়। এ-সম্পর্কে অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খানের বক্তব্য স্মর্তব্য :
“সমাজ, সময় ও ইতিহাসপ্রবাহ কখনো কখনো বস্তুনিষ্ঠ অনিবার্যতায় একটা জীবনবলয়ের সামগ্রিক গতিবিধিকেই করে দেয় আমূল পরিবর্তন। জাতীয় জীবনে সংঘটিত ঘটনাপুঞ্জ সমাজ ও জীবননিহিত প্রাসঙ্গিকতায় সম্মিলিত-চেষ্টা চৈতন্যে সঞ্চার করে উজ্জীবনের প্রাণময় গতিবেগ। জীবনের অভিঘাত, আন্দোলন, প্রতিবাদ, রক্তক্ষরণ ও প্রতিরোধের প্রচণ্ডতায় নিতান্ত আত্মমগ্ন ব্যক্তিকেও করে তোলে সচকিত, উদ্দীপ্ত। বাঙালি জাতির আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে যে আলো-অন্ধকারের দোদুল্যমানতা ১৯৪৭-১৯৭০ কাল-পরিসরে পরিব্যাপ্ত— বাংলাদেশের কবিচৈতন্যে তার দ্বন্দ্বময় উপস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৪৭-এর ভারত-বিভাগ সমকালীন কবিমনকে একটা অনিশ্চয়তা ও সংশয়ের কালো স্রোতে নিক্ষেপ করেছিলো, বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন সেই সংশয়ের অন্ধকারকেই কেবল দূরীভূত করলো না, বাংলাদেশের কাব্যযাত্রার সামগ্রিক গতিবিধিতেই রূপান্তর সাধন করলো। কিন্তু ১৯৫৮ সালের সামরিক উত্থান সেই জীবনময় গতিবেগেকে করলো প্রতিহত। শিল্পীর স্বাধীনতার জন্য গণতন্ত্র একটি মৌলিক পূর্বশর্ত, আয়ুবী ডিকেড সেই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সামরিক একনায়কতন্ত্রের প্রচণ্ডতায় অবরুদ্ধ করে রেখেছিলো। ঊনসত্তরে সেই আগ্রাসী একনায়কত্বের প্রাসাদই কেবল ধ্বসে পড়লো না, নব্য-উপনিবেশবাদের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রজাল উন্মোচিত হলো জাতীয় চৈতন্যে।” [বাংলাদেশের কবিতা : সমবায়ী স্বতন্ত্রস্বর/একুশে পাবলিকেশন্স/ ঢাকা/পৃষ্ঠা-৩৪]
এই চৈতন্যোদয়েরই অনিবার্য অমৃত হলো দীর্ঘ ন’মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশভূমি— আমাদের স্বপ্নস্বর্গ বাংলাদেশ। জাতীয় জীবনের অন্তর্বাস্তবতার এই পট-পরিবর্তন কবির বহির্বাস্তবতার চেতনাজগৎকে যে গভীরভাবে রেখাপাত করবে, সেটাই স্বাভাবিক। জীবন-যৌবন-জৈবিকতার প্রশ্নে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যে-ধারার অনুগামী হোক-না কেন কোনো শিল্পী, জীবনের অন্তর্কাঠামোজাত প্রতিক্রিয়ায় তার প্রকাশ নিশ্চিত। মুক্তিযুদ্ধ সমসাময়িক আমাদের কবিগোষ্ঠী সেই জীবনবাস্তবতা কিংবা জীবনবীভৎসতাকে অস্বীকার করতে পারেন নি, কিংবা করেন নি— তাঁদের কবিতায় প্রভাব বিস্তার করে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি এবং প্রেক্ষিতে বিদ্যমান থাকে মুক্তিযুদ্ধসংযুক্ত বিভিন্ন চালচিত্র।
প্রাপ্তকথন :
টিক্কা-ইয়াহিয়া’র নীল নকশা অনুযায়ী পাশ্চাত্য অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী একাত্তরের পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে নিরীহ এবং নিরস্ত্র এদেশীয় বাঙালির উপর চালায় অতর্কিত আক্রমণ। শুরু হয় ধিক্কৃত গণহত্যা, পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড, জ্বালন-পীড়ন ধ্বংসযজ্ঞ; তদ্সঙ্গে নারীনির্যাতন, নারীধর্ষণ এবং ধর্ষণপর হত্যা। সেই বিবর্ণ পাণ্ডুর দিনগুলিতে এদেশীয় বাঙালি জায়া, জননী কিংবা কন্যারা হয় নানাভাবে কলঙ্কিত— পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ঘৃণ্য লালসার শিকার। একজন হাসান হাফিজুর রহমানের ‘বীরাঙ্গনা’য় ঘটে এই বীভৎসতার বিস্তর প্রতিফলন :
“তোমাদের ঠোঁটে দানবের থুথু,
স্তনে নখরের দাগ, সর্বাগ্রে দাঁতালের ক্ষতচিহ্ন প্রাণান্ত গ্নানিকর।
লুট হয়ে গেছে তোমাদের নারীত্বের মহার্ঘ্য মসজিদ।
উচ্ছিষ্টের গদগদে লাঞ্ছনা তোমরা
পরিত্যক্ত পড়ে আছ জীবনের ধিক্কৃত অলিন্দে নাকচ তাড়িত।
… … … …
লাঞ্ছনার বেদীমূলে তোমরা সবাই
একেকটি জীবন্ত স্মৃতচিহ্ন হয়ে গেছ আজ,
সংগ্রামের খর প্রাণকণা অনশ্বর বীরাঙ্গনা।”
বাংলাদেশের লাঞ্ছিত নির্যাতিত নারীকে ‘টু উইমেন’ ছবির গীর্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনের সঙ্গে তুলনা করে আসাদ চৌধুরী বিশ্ববিবেককে জানান আহ্বান :
“টু উইমেন ছবিটা দেখছ বারবারা?
গীর্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে
আমি কাঁদি নি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল
সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো— বাংলাদেশে
তিরিশ হাজার রমণীর নির্মমতার অভিজ্ঞতা শুনে
তিনি শিউরে উঠতেন।”
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পশ্চিমা নরঘাতকদের ভয়াবহ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের একাংশচিত্র ফুটে ওঠে জসীম উদ্দীনের ‘দগ্ধগ্রাম’ কবিতায় :
“এইখানে ছিলো কালো গ্রামখানি, আম কাঠালের ছায়া,
টানিয়া আনিত শীতল বাতাস কত যেন করি মায়া।
… … …
কিসে কি হইল, পশ্চিম হতে নর-ঘাতকেরা আসি,
সারা গাঁও ভরি আগুন জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।
সারা গাঁও ভরি আগুন জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।
মার কোল হতে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান,
পিতার সামনে মেয়েরে কাটিয়ে করিল রক্ত-স্নান।
… … …
সারা গাঁওখানি দগ্ধ শ্মশান, দমকা হাওয়ার ঘায়,
সারা গাঁওখানি দগ্ধ শ্মশান, দমকা হাওয়ার ঘায়,
দীর্ঘ নিঃশ্বাস আকাশে পাতালে ভষ্মে উড়িয়া যায়।”
একাত্তরের শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলিতে এদশীয় প্রতিটি বাঙালিই ছিলো পাকসেনাদের হাতে মৃত্যুপথযাত্রী। হাসান হাফিজুর রহমান তাই যথার্থই ব্যক্ত করলেন— ‘লুকোই শ্বাসেরও শব্দ যদি ভুল ভেবে কবর পেরিয়ে যায় কোনোমতে/ হয়তো বাঁচতে পারি কয়েকটা আকুল মুহূর্ত আরো’। [‘লুকোই শ্বাসেরও শব্দ’] ষড়ঋতুর দেশ বাঙলায় প্রত্যেক ঋতুতে ঋতুতে প্রকৃতি হয় নব-নব সাজে সজ্জিত। কিন্তু একত্তরের রক্তস্নাত যুদ্ধে বাঙলা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন ঋতুর দেশ। রক্তাক্ত ঋতুতে রক্তাক্ত বাঙলার সকরুণ রূপটি চিত্রিত হয় হাসান হাফিজুর রহমানের আর-একটি কবিতায়— ‘রক্তস্রোতে ভাসে দিব্য মুখ তোমার/ এ এক ভিন্ন মুখ/ শোণিত নিবাসের অধিবাসী তুমি আজ’। [‘এ এক ভিন্ন মুখ তোমার’] ঐ মুহূর্তের পটভূমি নিয়ে রচিত বাঙলার লাশ কবিতায় সানাউল হক প্রত্যক্ষ করলেন তা বের অগ্নিযজ্ঞে বাংলাদেশের বন্ধ্যাজমিকে। জুলফিকার মতিনের ‘স্বৈরিণী স্বদেশ তুই’ কবিতায় তছনছ হওয়া তরঙ্গভঙ্গ বাংলাদেশের প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে আরও স্পষ্ট :
“তছনছ সারাদেশ— দারুণ আগুনে
দগ্ধীভূত ঘরবাড়ী, মৃত শিশু পশু
জ্বলন্ত অনলে সিদ্ধ ধর্ষিতা নারী
আগুনের লেলিহান স্ফূলিংগ মালা
লকলকে জিহ্বা মেলে মূঢ় স্পর্ধায়
আকাশ পোড়াতে চায়, পোড়া গন্ধ ভাসে
বিকৃত গলিত শব শকুন পাহারা
যেন কোন নরকের উন্মুক্ত দুয়ার
নির্বিকার প্রতিকল্পে বিপন্ন বিতান।”
হুমায়ুন কবিরের ‘মার্চে প্রথম কারফ্যু’ কবিতায় পাকিস্তানী সামরিকবাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনউৎসবের তাণ্ডবলীলা এবং সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় অবরুদ্ধশহরের জীবনসঙ্কট বাস্তবতায় মূর্ত। তাঁর ‘গেরিলা’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের কার্যক্রম ও তাৎপর্য আকর্ষণীয়। কবিতাটিতে শব্দের গাঁথুনি দিয়ে যে অবয়ব তৈরি হয়েছে তা একজন গেরিলারই প্রতিচ্ছবি। স্বাধীনতাস্পৃহা যে একাত্তরে যুদ্ধের সময় সকল শ্রেণির মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য, তার চিত্র মেলে সৈয়দ শামসুল হকের গ্রামীণ কবিতায়। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কারণে মতাদর্শের লড়াই যে এদেশের হাওয়াতেও বিদ্যমান, তার ইঙ্গিত এ-কবিতায় স্পষ্ট। শহীদ কাদরী’র ‘নিষিদ্ধ জার্ণাল থেকে’, মহাদেব সাহা’র ‘নিজস্ব অ্যালবাম’, মাহমুদ আল জামানের ‘যখন ফিরছি’, শামসুল ইসলামের ‘কঙ্কাল, কঙ্কাল, এতো কঙ্কালের মাঝে’ প্রভৃতি কবিতায় স্বদেশসঙ্কট ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নগ্নচিত্র চিত্রিত হয়েছে সুনিপুণভাবে।
ভিনদেশীয় খানসেনাদের সঙ্গে ছিলো এদেশীয় দালালদের অদ্বৈত সহাবস্থান। এরা উভয়ই যে গণহত্যা, নারীধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি হীন অপকর্মে ছিলো দ্বিধাহীন, তার সাক্ষাৎ মেলে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের ‘গোলাম আযমের গল্প’, আতাউর রহমানের ‘নিষিদ্ধ নগরে আছি’ প্রভৃতি কবিতায়। তৎকালীন সময়ে আতঙ্ক-অস্বস্তি-অস্থিরতায় অবশপ্রায় হয়ে এদেশীয় প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয় নেয় ভারতের শরণার্থী শিবিরে। তাদের মানবেতর জীবনচিত্র স্থান পায় সমসাময়িক বিভিন্ন কবিতায়। শরণার্থীদের নির্বাসনের পশ্চাৎভূমি জানাবার জন্য আসাদ চৌধুরী তাঁর ‘বারবারা বিডলারকে-২’ কবিতায় উচ্চারণ করেন :
“অভিধান থেকে নয়
আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কি?
জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিআলা ডাক টিকিটে খোঁজ
থাকবে না স্বাধীনতার
আমাদের মুক্তিযোদ্ধার কাছে এসো।”
স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশের কবিরা ছিলেন কলমসৈনিকের আসনে আসীন। চল্লিশের দশকের অন্যতম কবি আহসান হাবীব এই স্বাধীনতাকে উপলব্ধি করলেন বিশেষ একটি অশরীরী অস্ত্র হিসেবে। নির্মলেন্দু গুণ তাঁর হৃদয়ের মতো মারাত্মক একটি আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে স্বাধীনতাকে তুলনা করলেন। তিনি স্বাধীনতার সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজলেন জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা উলঙ্গ শিশুর মাঝে। শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতার যে ক্রমব্যাপ্তি, তা দেশীয় ঐতিহ্যিকতায় উন্মুখ : ‘স্বাধীনতা তুমি/ রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/ স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা’। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ কবিতায় কবি এক-ই সঙ্গে দেখেয়েছেন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ বাঙালির প্রহরগণনা এবং আত্মবিশ্বাসের অহমিকা :
“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা , তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
… … …
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বতি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে, দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা”
শামসুর রাহমানের মতো রফিক আজাদের কণ্ঠেও বাজে প্রতীক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি :
“গর্ভিণী নারীর মতো মনে প্রাণে প্রতীক্ষায় আছি।
মায়েদের মতো— আমারো দারুন ভয়— গর্ভপাতে :
আবাঞ্ছিত দুঃসংবাদ বয়ে কখনো এসো না দ্রুত।
তোমাকে বুঝতে হবে জননীর সঠিক সময়
প্রতিটি ইন্দ্রিয় চায় উপযুক্ত বুঝে তাই
তোমাকে আসতে হবে, কায়-মনে তৈরি হয়ে আছি।”
‘বাঙলা ছাড়ো’ কবিতায় সিকান্দার আবু জাফর ঔপনিবেশিকদের এদেশের পবিত্রমাটি ছাড়ার জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এসময় আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো পরাবাস্তববিলাসী কবিকেও দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের অনুভবে আসক্ত হতে :
“নারকেল সবুজ পাতার বালির ঢাকা চাঁদের সোনালী কামান
নিঃশব্দ ওঙ্কারে গর্জে উঠে তুমুল জ্যোৎস্না ছুঁড়ে মারে
এই চলে সারা রাত
জ্যোৎস্নায় তমসায় বাদানুবাদ
গৃহ-যুদ্ধ মুক্তি-যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে যায়।”
শত্রুর বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়তে হাসান হাফিজুর রহমানের শপথ :
“নিহিত ভায়ের লাশ কাঁধে বয়ে ঢের
গড়েছি মিনার, হেঁটে গেছি পথ।
আর নয়, চাই শত্রুর লাশ চাই
—এইবার এই বজ্র শপথ।”
মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত খাঁচাবন্দি বাংলাদেশের মানুষপক্ষী শুনতে পায় মুক্তির বার্তা, পোড়া-মরা-পঁচা-বিবর্ণ প্রকৃতির অঙ্গেও ফিরে আসে যৌবনের শোভা— এমন রোমাঞ্চিত মুহূর্তের বর্ণনা ধরা পড়ে হুমায়ুন আজাদের ‘মুক্তিবাহিনীর জন্য’ কবিতায়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সদ্যস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশের রূপ বর্ণনা করে আবু হেনা মোস্তফা কামাল ‘ছবি’ কবিতায় আহ্বান জানান বিশ্ববাসীকে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, শামসুর রাহমান, সুফিয়া কামাল, আতাউর রহমান, আহমদ রফিকসহ অনেকেই তাঁদের হারানো প্রিয়জনদের স্মরণে লিখলেন, যা মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল হিসেবে গণ্য বাঙলা কাব্যে : ‘ভালোবেসেছিলে এই ধরণীরে, ভালবেসেছিলে দেশ/ তাই বুঝি তোর কুমারী তনুতে জড়ায়ে রক্তবেশ/ প্রথম শহীদ বাংলাদশের মেয়ে/ দুটি ভাই আর মায়ের তপ্ত বক্ষ রক্তে নেয়ে/ দেশের মাটির ’পরে/ গান গাওয়া পাখী নীড়হারা হয়ে/ লুটালি প্রবল ঝড়ে।’ [‘মেহেরুন্নেসা’, সুফিয়া কামাল]; কিংবা, ‘এখন বিজয়ানন্দে হাসছে আমার বাংলাদেশ/ লাল চেলি গায়ে, কী উদ্দাম। গমগমে/ রাস্তাগুলো সারাক্ষণ উজ্জ্বল বুদ্বুদময়। শুধু আপনাকে/ হ্যাঁ, আপনাকে মুনীর ভাই/ ডাইনে অথবা বাঁয়ে, কোথাও পাচ্ছি না খুঁজে আজ।’ [‘রক্তাক্ত প্রান্তরে’, শামসুর রাহমান] প্রিয়জনদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে মুহম্মদ নূরুল হুদার মূল্যায়ন : ‘তোমাদের হাড়গুলো বাংলার হৃৎপিণ্ডে অবিনাশী ঝড়/ বাঙালীর জন্মতিথি, রক্তে লেখা ষোলো ডিসেম্বর’।
প্রান্তকথন :
অপরিমেয় আত্মত্যাগ ও আত্মাহুতির মাধ্যমে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশী বাঙালি জাতির এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাসূচক— একথা যেমনি সাধারণ ক্ষেত্রে তেমনি কাব্যান্দোলনেও সমভাবে প্রযোজ্য। সাতচল্লিশ-পরবর্তী সুদীর্ঘ চব্বিশ বছর এদেশীয় নাগরিকদের প্রতিমুহূর্তে লড়াই করতে হয়েছে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে, জাতিসত্তার প্রশ্নে, শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং এক সময় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে। এ-সময় ঔপনিবেশিক সরকারের শাসন-শোষণ-নির্যাতন কিংবা চুম্বকঘর্ষণে সংক্রামিত এবং স্থিমিত হয়ে পড়ে এখানকার বহু কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী। ফলে হাজার বছরের লালিত মেঠো মানবিকতা ও সরল মূল্যবোধের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় পুরো দেশজুড়ে। পিছু চলতে চলতে পিঠ যখন ঠেকে যায় প্রস্তরদেয়ালে ঠিক তখনই শুরু হয় জোর প্রতিহত প্রচেষ্টা, মুক্তির উন্মাদনায় গণমানুষের অস্বভাবিক অস্থিরতা। আমাদের ভাষা-সাহিত্যের সবচেয়ে আদুরে মেয়ে বাঙলা কবিতা এই রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অর্জন করে আরেকটি স্বতন্ত্রমাত্রা। এ-সময়কার কবিরা হয়ে ওঠেন আরো বেশি জীবনঘনিষ্ঠ-জীবনজিজ্ঞাসু-জীবনসন্ধানী, আরো বেশি রাজনৈতিক সচেতন। ফলে মুক্তিযুদ্ধে ঘটে তাঁদের ঐকান্তিক অংশগ্রহণ। স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিতে তাঁরা হন সক্ষম।
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা মানে মুক্তির মন্ত্র। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাঙলা কবিতার স্তিমিত অবসাদকে পশ্চাতে ফেলে নবোদ্দামে এগিয়ে যাওয়ার যে বাঁকবদল তার শুভসূচনা বলা যায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রাজনৈতিক কবিতার হাত ধরে। এক্ষেত্রে উপরি-উল্লেখিত কবিবর ছাড়াও আবুল হোসেন, আবুবকর সিদ্দিক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আজীজুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মোহাম্মদ রফিক, আবুল হাসান, আল মুজাহিদী, সাজ্জাদ কাদির, হেলাল হাফিজ, অসীম সাহা, মাহবুব সাদিক; কিংবা মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে আবিদ আনোয়ার, আবিদ আজাদ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, হাসান হাফিজ, দাউদ হায়দার, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অনীক মাহমুদ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, রেজাউদ্দিন স্টালিন, মারুফ রায়হান প্রমুখ কবিগণ পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সত্যি বলতে কী, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর কবিতা লিখেন নি— এমন কবি খুঁজে পাওয়া দায়। তবে আবেগময়তা, শ্লোগানসর্বস্বতা কিংবা সরাসরি রাজনৈতিক ভাষ্য উপস্থাপনার অভিযোগে অধিকাংশ কবি এবং কবিতা যে অভিযুক্ত— একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বাংলাদেশী বাঙালি জীবনে এবং বাঙলা কাব্যান্দোলনে বিশেষ গুরুত্ববহ— জাতির যে-কোনো ক্রান্তি কিংবা ক্লান্তিলগ্নে সম্মোহনী-শক্তি হিসেবেই সুদৃঢ় রবে এর স্বতন্ত্র অবস্থান। কেননা আবেগের মধ্যেও একটা মাহাত্ম্য আছে; শ্লোগানে আছে ছন্দ কিংবা সুর; রাজনৈতিক ভাষ্যে বিকশিত চেতনা দীপ জ্বালিয়ে যায় নীরবে দূর, বহুদূর।
সেপ্টেম্বর ২০০২
Discussion about this post