মেহেদী ধ্রুব
শৈশবে মাকে হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে পড়ি। এসএসসির সময় বাবাকে হারিয়ে আমি পাথরের মতো পড়ে থাকি। মনে হাজারো কথা, বুকে হাজারো কষ্ট, কিন্তু সেইসব কথা বা ব্যথা প্রকাশ করার পথ জানা ছিল না। সব দলামলা হয়ে যাচ্ছে। পালাই পালাই ভাব আমাকে পেয়ে বসে। নিশ্চুপ নিরালা হোস্টেলে সবাই যখন গভীর ঘুমে তখন কাগজ-কলম নিয়ে পড়ে থাকি। মা ও বাবা ঘুরিফিরে আসে। খাতার মধ্যে কলম আটকে থাকে, ভাষাগুলো সুটকেসের ভিতরে ভূতের মতো চিৎকার করে। তারপর ভার্সিটি লাইফে হঠাৎ মুক্তদুয়ারের কথা শুনি সিনিয়র এক ভাইয়ের কাছে। অথচ, মুক্তদুয়ারের কর্ণধার মাওলা প্রিন্স স্যারের কাছে আমি ‘বাবু’ বলে পরিচিত; যার পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ নেই।
প্রতি রবিবার মুক্তদুয়ারের আড্ডা জমে। সিনিয়রদের নিয়ে এই আড্ডা চলে স্যারের রুমে। আমি নিয়মিত খোঁজ রাখি। ভাইয়াদের কাছ থেকে জানতে পারি, মুক্তদুয়ার প্রথম সংখ্যা বের করবে। কবিতা জমা হয়েছে অনেক। কিন্তু, গল্প পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকজন চেষ্টা করেছেন, কিন্তু স্যার বলছেন এগুলো গল্প হয়নি। কথাটা শুনে আমি চিন্তায় পড়ি, আমিও যে কবিতা লিখি। হঠাৎ মনে হলো এইটাকে সুযোগ হিসেবে নেওয়া যায়, আমি যদি গল্প লিখি তবে আমার জন্য মুক্তদুয়ারের দুয়ার খুলে যাবে। সাথে সাথে লিখতে বসি। আমার দেখা গল্প, জানা গল্প লিখতে থাকি। জামিল ভাইকে বলি আমিও যাব। জামিল ভাই আমাকে নিয়ে যান। আমাকে দেখে স্যার কিছুই বলেন না, আমাকে স্বাগত জানালেন না; আমার মনে হয় আমি আড্ডাতে এসেছি বলে তিনি বিরক্ত হয়েছেন। যথারীতি আড্ডা শুরু হয়, কোন বই নিয়ে আলোচনা হয়েছিল মনে নেই, আসলে আমি আমার লেখা গল্প নিয়ে এতবেশি উত্তেজিত ছিলাম যে কোন বই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কে কী লিখে এনেছে, তা খেয়ালই করি না। সবশেষে আমার পালা। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কেন এসেছি, কী লিখি, কী লিখেছি। আমি বললাম, গল্প লিখে এনেছি। স্যার, গল্পের কথা শুনে মনোযোগ দিলেন, আর বললেন, ‘পড়ো।’ আমি কাঁপা কাঁপা গলায় গল্প পড়তে থাকি। গল্প পড়া শেষ হলে স্যার সবার অভিমত জানতে চান। সবাই স্বীকার করেন যে এটি গল্প হয়েছে। স্যারও স্বীকার করেন এটি গল্প হয়েছে। কিন্তু, স্যারের চোখে আমি অবিশ্বাস আবিষ্কার করি। আমার মনে হতে থাকে স্যার হয়তো ভাবছেন এই গল্প আমি কোথাও হতে মেরে দিয়েছি। মিশ্র অভিজ্ঞতা নিয়ে মুক্তদুয়ার থেকে বের হয়ে আসি। হলে এসেই আবারও লিখতে বসি। মায়ের গল্প লিখি। গল্প লেখার সময় জামিল ভাইকে দেখাই। পরের সপ্তাহে আবারও গল্প পড়তে থাকি। পিনপতন নীরবতা নেমে আসে স্যারের রুমে। গল্পের পরিণতি শুনে অনেকে আপ্লুত হন। জামিল ভাই স্যারকে বললেন, ‘এ গল্প সত্যি, বাস্তব, লেখার সময় আমি দেখছি।’ স্যারের চোখে অন্য এক স্নেহ ও আশার পরশ দেখতে পাই। আমার ভাষাগুলো মুক্তদুয়ারে এসে মুক্ত হলে গেল।
একদিন স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি একটু ভয় পাচ্ছি। কোনো ভুল করিনি তো আবার। স্যারের রুমে ঢুকতেই স্যার বললেন, ‘এই নাও লেখক কপি।’ আমি হতবাক হয়ে যাই। লেখক সূচির শুরুর দিকেই আমার নাম। মাকে নিয়ে লেখা গল্পটি স্যার নিজ দায়িত্বে ‘চিহ্ন’ পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। চিহ্নের যুগবর্ষযাপন সংখ্যায় মাত্র তিনটি গল্প ছাপা হয়। জাকির তালুকদার ও শিমুল মাহমুদের সঙ্গে আনকোরা মেহেদী ধ্রুবর গল্প! আমার চোখে পানি চলে আসে, স্যারও অনেক খুশি হলেন, আর আমাকে উৎসাহ দিলেন। নজরুল-জয়ন্তীতে চিহ্নের সম্পাদক শহীদ ইকবাল স্যার যখন আমার পিঠ চাপরে দিলেন তখন আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল।
আজকের মেহেদী ধ্রুব হওয়ার নেপথ্যে মুক্তদুয়ার ও মাওলা প্রিন্স স্যারের ভূমিকা সর্বাধিক। মুক্তদুয়ার ও মাওলা প্রিন্স স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
Discussion about this post