সিনথিয়া জাহান বিথুমণি
দিবারাত্রি প্রেমকাব্য (২০১৪) কাব্যগ্রন্থের কবি মাওলা প্রিন্সের পরিচয় বহুমাত্রিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি একাধারে কাব্য ও কথাসাহিত্য রচনা, গবেষণা এবং সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে কৃতিত্বের সাথে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। এ-যাবৎ তিনি প্রকাশ করেছেন ০৫ টি কাব্যগ্রন্থ, ০১ টি উপন্যাস এবং ০৯ টি গবেষণাগ্রন্থ। এখানে আলোচ্য দিবারাত্রি প্রেমকাব্য তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। নর-নারীর শাশ্বত প্রেমের ওপর ভিত্তি করে রচিত এ গ্রন্থটি কবি মাওলা প্রিন্সের একটি উল্লেখযোগ্য শিল্পপ্রয়াস।
বাংলা কাব্যের ধারায় নর-নারীর প্রেম একটি অতি প্রাচীন এবং কালাতিক্রমী অনুষঙ্গ। চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা কবিতায় মানব-মানবীর প্রেম পেয়ে এসেছে বৈচিত্র্যময় শিল্পরূপ। কবি মাওলা প্রিন্সের দিবারাত্রি প্রেমকাব্য এ ধারারই একটি ব্যতিক্রমী কাব্যগ্রন্থ। কাব্যরসের সুনিপুণ প্রয়োগ এবং ছন্দের কারুকার্যময় প্রবহমানতার গুণে গ্রন্থটি নির্লিপ্ত পাঠককেও মোহিত করতে সক্ষম। প্রচলিত ধারার কাব্যগ্রন্থের ন্যায় এটি নির্দিষ্ট সংখ্যক কতগুলি কবিতার সমন্বয়ে গ্রন্থিত নয়; বরং সমগ্র গ্রন্থটিই একটি দীর্ঘকবিতা। কবি মাওলা প্রিন্স এই কাব্যগ্রন্থে কথক হিসেবে রূপায়িত করেছেন একজন প্রেমাকাঙ্ক্ষী যুবক কবিকে। বস্তুত, এই যুবকের মধ্যেই ‘প্রেমিক’ ও ‘কবি’ এই দ্বৈত সত্তার অপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ আত্মিক প্রেমচেতনার শৈল্পিক অভিব্যক্তিকে মূর্ত করে তুলেছেন কবি।
কাব্যগ্রন্থটির কথক-কবির বর্ণনায় উঠে এসেছে তার প্রেয়সীর প্রসঙ্গ। সে কবির চেতনায় কখনো ‘মেঘবালিকা’, কখনো ‘চির চঞ্চল চলন্তিকা’ কখনো ‘অশ্রুমুখী’ আবার কখনো ‘লজ্জাবতী লাজুক লতা’র মূর্তি নিয়ে তার প্রেমাবেগকে পুনঃপুনঃ সঞ্জীবিত করে তুলেছে। কৈশোরে তার সান্নিধ্যে অনুভূত প্রথম প্রেমাবেগের সুখস্মৃতিটুকু কবি সযত্নে অন্তরে ধারণ করেছে। কিন্তু, প্রেয়সীর সাথে সাক্ষাতের দীর্ঘবিরতি যুবক কবিকে করে তুলেছে ব্যাকুলপ্রাণ :
কেন এ অনিদ্রা অনন্তকাল জুড়ে¾
কেন এ অশ্রুপাত পাষাণ-প্রাণে¾
কেন এ উচ্ছ্বাস দুচোখ ভরে¾
সময়ে যারে করিনি আপন¾ অসময়ে সেই প্রিয়জন¾
হরণ করে মন বারেবারে।
[মাওলা প্রিন্স (২০২০), পৃষ্ঠা : ১৪]
কিন্তু, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রেয়সীর সান্নিধ্য পেয়েও বিরহ-ব্যথাতুর কবির এই মর্মপীড়নের অবসান ঘটে নি। বরং তাঁর এই বিচলিত ভাব পেয়েছে নতুন মাত্রা। প্রেমিকার নৈকট্য কবিচিত্তকে করেছে দ্বিধামগ্ন :
যার জন্য এতো ক্ষয়¾ সে যখন দিলো অভয়¾
তখনি ন্যুজ আমি¾ হলাম অভিমানী¾ কে জানে কেন এমন হয়!
[মাওলা প্রিন্স (২০২০), পৃষ্ঠা : ১৮]
কবির এই বিভ্রান্তির হেতু উদ্ঘাটন করা যায় কাব্যপাঠে খানিক অগ্রসর হলেই। গ্রীষ্মের তাপদাহে বকুলের ঘ্রাণ ক্লান্ত প্রাণকেও যেমন জাগিয়ে তোলে, তেমনি নিকটে প্রাপ্ত প্রেয়সীর পক্বযৌবন কবির মর্মনিহিত কামতৃষ্ণাকে তীব্র করে তোলে। তবে, মুহূর্তেই সচকিত হয়ে ওঠে সে। কেননা, কবির চেতনায় তার প্রেয়সী মেঘবালিকা স্বর্গীর মহিমা নিয়ে সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কিন্তু, সেই পরিশুদ্ধ চেতনার স্তরে কামজ আকাঙ্ক্ষার অনুপ্রবেশ তাই কবিকে করেছে লজ্জিত, উদ্বিগ্ন ও অধীর :
এতো পথ পাড়ি দিয়ে¾ এতো এতো ক্লান্তি নিয়ে¾ তুমি হলে রাধা!
আমিও তপস্যা ভুলে¾ রাজকর্ম ভুলে গিয়ে¾ ভুলে হলাম বাঁধা!
তবে কি কামহীন প্রেম নেই¾ বাঁচে না প্রেম কাম ছাড়া!
তোমার-আমার স্বর্গীয় প্রেম হলো স্বর্গ-হারা!
[মাওলা প্রিন্স (২০২০), পৃষ্ঠা : ১৯]
কবির বিবেচনায় প্রেমিকার প্রতি দৈহিক আকর্ষণের জাগরণ প্রেমের আত্মিক হৃদয়াবেগের শ্লীলতাহানিরই নামান্তর। তাই, কবি বারবার ফেরারি হয়ে তাঁর মেঘবালিকার থেকে দূরে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। তবে, এই বিচ্ছেদ এক পর্যায়ে কবিকে আর কাতর করে নি। কেননা, প্রেয়সীর অস্তিত্ব সার্বক্ষনিকভাবে অনুভূত হয়েছে তাঁর অন্তরে :
প্রিয়া তুমি কাছে নেই¾ কি হয়েছে তাতে।
চক্ষু বুজলে তোমায় পাই¾ আছো তুমি সাথে।
[মাওলা প্রিন্স (২০২০), পৃষ্ঠা : ২৮]
প্রকৃতির মাঝেও যুবক কবি খুঁজে পেয়েছে প্রিয়াসান্নিধ্য। কবির এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই নিম্নোক্ত চরণগুলিতে :
বৃষ্টির মাঝে কুমারী বালি¾ এ তো বারি নয়, মেঘবালিকা¾
তোমার চুম্বনে সিক্ত আমি¾ সুরভি বিলায় বুনো শেফালিকা¾
শিশিরের মাঝে কুমারী বালি¾ জল নয়, মেঘবালিকা¾
যেন ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াছুঁয়ি¾ অভিসারে অনামিকা¾
জলতরঙ্গে কুমারী বালি¾ ঢেউ নয়, মেঘবালিকা¾
ডুবসাঁতারে শৃঙ্গার হলো¾ চির চঞ্চল চলন্তিকা¾
[মাওলা প্রিন্স (২০২০), পৃষ্ঠা : ২০]
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে প্রেমিকের এই প্রিয়াদর্শনের অনুভূতিমূলক মাওলা প্রিন্সের এই কাব্যপ্রয়াসের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার নিম্নলিখিত পঙক্তিগুলোর সাথে :
তোমার পাতায় দেখেছি তাহারি আঁখির কাজল-লেখা,
তোমার দেহেরই মতন দীঘল তাহার দেহের রেখা।
তব ঝির ঝির মির মির যেন তারি কুণ্ঠিত বাণী,
তোমার শাখায় ঝুলানো তারির শাড়ির আঁচলখানি।
[কাজী নজরুল ইসলাম, ‘বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি’, চক্রবাক]
এভাবেই প্রেমিক-প্রেমিকার অর্ন্তনিহিত এই আত্মিক প্রেমের আবেদন নিহিত রয়েছে সমগ্র কাব্যগ্রন্থটি জুড়ে। এ কাব্যের প্রেমিক উপলব্ধি করেছে যে, ভোগে নয় বরং পারস্পরিক হৃদয়গত আত্মসমর্পণেই প্রেমের প্রকৃত আনন্দ অনুভূত হয়। তার এই উপলব্ধিপ্রসূত কয়েকটি চরণ নিম্নরূপ :
প্রেম মানে পারস্পরিক আত্মসমর্পণ¾
প্রেম মানে পারস্পরিক আত্মবিসর্জন¾
প্রেম মানে হাতে হাতে পাওয়া নয়¾ প্রাপ্তির আয়োজন¾
[মাওলা প্রিন্স (২০২০), পৃষ্ঠা : ২৯]
দিবারাত্রি প্রেমকাব্য -তে বিস্তৃত আত্মিক প্রেমের এই প্রবাহ নতুন মোড় নিয়েছে কাব্যগ্রন্থটির শেষাংশে। এখানে কথকের প্রেমচেতনা উন্নীত হয়েছে আধ্যাত্মিক চেতনায়। কবি মাওলা প্রিন্স প্রযুক্ত এই অধ্যাত্মবাদী ভাবধারায় বাউল দর্শনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাউল মতাদর্শীরা নিরাকার স্রষ্টায় বিশ্বাসী নয়। তারা মানুষের মাঝেই ‘মানুষ রতন’ অর্থাৎ পরমাত্মার অন্বেষণ করে। তাই, প্রিয়জনকে প্রাপ্তির মাধ্যমেই তাদের পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভের সাধনা পূর্ণতা পায়। এ কাব্যের শেষাংশে দেখা যায়, কথক তার প্রেয়সীর পক্ষ থেকে পেয়েছে প্রেমের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি। আর, এই স্বীকৃতিই তাকে এনে দিয়েছে পরমাত্মাকে প্রাপ্তির আনন্দ। কবি তাই তাঁর প্রেয়সীকে বলেছেন :
সখি, আমার বিধি হইলো বাম¾
আমার বিধি হইলো বাম¾
আল্লা-রসূল নাই গো সখি¾ জপি তোমার নাম¾ ।
[মাওলা প্রিন্স (২০২০), পৃষ্ঠা : ৪৪]
বাউল মতাবলম্বীদের বিশেষ আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বৈরাগ্যসাধন। সংসার-ধর্ম পালন তাদের আদর্শের বিপরীত। আলোচ্য গ্রন্থের কথক-কবিকেও তাই শেষাবধি প্রেয়সীর প্রেম নিবেদন সত্ত্বেও বৈরাগ্য বরণ করেই পরিতৃপ্ত হতে দেখা যায়। তার এই প্রশান্ত চিত্তের শৈল্পিকভাষ্য প্রদান করে কবি মাওলা প্রিন্স তাঁর পাঠকের উদ্দেশ্যে বলেছেন :
আজ কবির চোখে অশ্রু নেই¾
কবি আর কাঁদবেন না¾
কবি আর পিছন ফিরে চাইবেন না¾
প্রচণ্ড ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে আসে
তেমনি আজ আমাদের কবি শান্ত-স্নিগ্ধ-নিরুত্তাপ-নিরুদ্বিগ্ন;
[মাওলা প্রিন্স (২০২০), পৃষ্ঠা : ৪৬]
বস্তুত, দিবারাত্রি প্রেমকাব্য মানব-মানবীর চিরকালীন আত্মিক প্রেমকে রূপায়িত করার পাশাপাশি এর আঙ্গিকগত সৌষ্ঠবের কারণেও বিশেষ হয়ে উঠেছে। ছন্দ এবং অনুপ্রাসের নানামাত্রিক প্রয়োগ, পঙক্তিবিন্যাসে কখনো সংলাপধর্মী, আবার কখনো বিবরণধর্মী শৈলী নির্মাণ এবং সর্বোপরি বহুক্ষেত্রে কবির নিজস্ব দর্শনের সমন্বয়ে দিবারাত্রি প্রেমকাব্য গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে মাওলা প্রিন্সের একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও শিল্পোত্তীর্ণ কাব্যগ্রন্থ।
সহায়ক গ্রন্থ :
১. কাজী নজরুল ইসলাম (২০১৪), চক্রবাক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা, ঢাকা ১২০৯
২. মাওলা প্রিন্স (২০২০), দিবারাত্রি প্রেমকাব্য, দ্বিতীয় মুদ্রণ, মুক্তদুয়ার, ৪০৫. কলা ভবন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ-২২২৪, বাংলাদেশ
Discussion about this post