নিলুফা আরা আক্তার
কল্পনার বিশাল এক মূর্তজগতের সত্যরূপ হচ্ছে কবিতার প্রজ্ঞান। কবির চেতনক্রিয়ায় এর জন্ম ও অভিজ্ঞতার সংযোজনে এর উত্তরণ–উদ্বোধন। স্বপ্ন–প্রত্যাশা ও বিশ্বাসকে উপজীব্য করে একবিংশ শতাব্দীর একজন মননশীল কবি মাওলা প্রিন্স (১৯৮৩খ্রি.-বর্তমান)। চৈতন্য ও আবেগের রূপময়তায় কাব্যশৈলীকে স্বতন্ত্র স্বরে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিল্পবোধের উঁচু স্তরে নিয়েছেন নিজস্ব কাব্যপ্রতিভাকে। কবির কবিতায় নিজস্ব শৈলীর পাশাপিাশি রয়েছে তাঁর বিচিত্র প্রবণতা ও তাঁর কবিতার প্রাতিস্বিকতা। সময়, সমাজ, সমকাল, প্রেম–প্রতিজ্ঞা–পরিণয় সবকিছুই অনুষঙ্গ হয়েছে তাঁর কাব্যশরীরের শিরায় শিরায়। কবি উন্মুখ হয়েছেন প্রণয় ও প্রকৃতির আবেশে; সোপার্জিত কণ্ঠে ভেঙ্গে ফেলেছেন কবিতার ফর্ম। ভেঙ্গে গড়েছেন নানানমাত্রার তত্ত্ব, প্রেয়সীর রূপাংকনে প্রয়োগ করেছেন চিত্রকল্পবাচক একগুচ্ছ কবিতা। সময়ের ব্যবধানে কবিতাও যে কলাকৌশলে ও তাৎপর্যে গভীর অনুধ্যানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, সেটি কবির কাব্যকায়ার মায়ায় অত্যন্ত প্রযত্নে উপস্থাপিত।
দুই.
মধুসূদন–রবীন্দ্রনাথ–নজরুল প্রবর্তিত ভারতীয় ধারা, তিরিশের কবিদের স্বতন্ত্র স্বর, চল্লিশের উত্তাল প্রতিবেশ, পঞ্চাশের জাগরণ, ষাটের দশকের দ্বন্দ্ববেদনা, সত্তরের ব্যক্তিক ও রাষ্ট্রিক সংকট¾ এমন নানান পরিস্থিতির জীবনচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন আমার আলোচিত কবি মাওলা প্রিন্স। ঐতিহাসিক পঠন–পাঠন করেছে তাকে সমৃদ্ধ; স্বীয় কবিসত্তাকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করার রসদ কবি পেয়েছেন সময়স্রোতের বিচিত্র অভিজ্ঞতায়। কবি মাওলা প্রিন্সের কাব্যগ্রন্থগুলো¾ নিশীথপ্রদীপে শঙ্খঝিনুকের চাষ (২০১৩), দিবারাত্রি প্রেমকাব্য (২০১৪), সব ঠিক, ঠিক কি, ঠিকটা কী (২০১৯) এবং আবার বছর কুড়ি পর (২০২০)। কবির কবিতায় প্রেরণাসঞ্চারক মানবিক প্রেমবোধের শাশ্বতরূপ, সমকালের সমাজবাস্তবতা, প্রকৃতির সাথে প্রণয়ের নির্যাস সম্বলিত মনোজাগতিক কবিসত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। পরমতত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে সংস্কৃতিকে ধারণ করেছেন তিনি। কবির সংরক্ষিত আবেগ আর জীবনঘনিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়ে আঙ্গিক ও বিচিত্র শৈলী–নিরীক্ষা করেছেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে। দ্বিতীয় কাব্যে রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন প্রেমচেতনা; যেখানে পরিশুদ্ধ জীবনবোধ দেহাতীত প্রেমের উন্মোচন ঘটিয়েছে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে ভর করে সংলাপের আদলে কথার পর কথার দৃঢ় বন্ধনে প্রকাশিত হয়েছে দেশীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চালচিত্র। কবি কুড়ি বছরের এককে চিরকালীন প্রেম, প্রণয় ও প্রকৃতির অনন্যতায় অনুসন্ধান করেছেন তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থের পরিক্রমা।
কবির উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হলো প্রেম ও সামাজিক সংকট উত্তরণের প্রচেষ্টা; যা কবির প্রাতিস্বিকতাকে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়। জগতের প্রতিটি বিষয়ে তাঁর বিস্ময় বর্তমান, যা শিল্পচৈতন্যের দ্যোতক। ব্যক্তি মাওলা প্রিন্স অতীন্দ্রিয়বোধের জগতের ঊর্ধ্বের কেউ নন, তাকেও মনোলোক ও প্রকৃতিলোকের মাঝে করতে হয় সেতুবন্ধন রচনা। কবির রচনার সাথে স্বকাল সংরক্ষিত হয়; বহমান থাকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনা। কবির ‘জাতিস্মর’ কবিতায় চমৎকারভাবে নিজ ইতিহাসের ফেলে আসা স্মৃতির কথা স্মরণ করেছেন :
আমার হৃদপিণ্ডে নষ্ট রক্তের কারবার
আমার মস্তিষ্ককোষে ভ্রষ্ট জাতির স্মৃতি
আমার শ্বাস–প্রশ্বাসে ত্রস্ত জীবের বেঁচে থাকার গর্জন
তোমরা আমাকে আবারো হত্যা করো।
[‘জাতিস্বর’, সব ঠিক, ঠিক কি, ঠিকটা কী]
সর্বনাশের কালিক অনুভব মুহূর্তে সেতুবন্ধন করে মহাকাব্যের যুগ থেকে আধুনিক নিরস্তিত্ত্বে। কবির স্থানাঙ্ক স্থান–কালে এবং সে স্থান হয় স্থানোত্তীর্ণ আর কাল হয় কালোত্তীর্ণ। কালিক বিস্তৃতি মিশে যায় সুদূর অতীতের মহাভারত থেকে নিকট বর্তমানের সমাজবাস্তবতায়। ক্রমশ মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পরিবর্তিত সভ্যতার বেড়াজালে; যেখানে পরিবর্তনের সাথে সাথে চলছে বিকৃত হওয়ার প্রবণতা, চলছে অনুৎপাদিত সংস্কৃতির বিস্তার। কবির ভাষায় :
যার আছে ডানাঅলা পায়রাশব্দ মাত্রাবোধের বিরামবিবেক¾
সেও তো বর্ধিষ্ণু হিজড়াসময়ের মোহনীয় বিভ্রমগুণে
ভুলে যায় স্বরলহরী গঙ্গাসরস্বতী!
[‘পৃথিবীতে এখন বিষগন্দম ফল’, সব ঠিক, ঠিক কি, ঠিকটা কী]
কবি শুধু নাগরিক জীবনের গ্লানি, শূন্যতা ও একাকিত্বের কথা বলেন নি, তিনি উজ্জ্বল জীবনরসের রসিকও বটে। পরমতত্ত্বে বিশ্বাস করে বলেন¾ ‘প্রতিশ্রুত প্রেম, শুধু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেমই বেঁচে থাকে অমলিন।/ গগণশিরীষ বনে¾ জনম নিবিড় ধ্যানে¾ পড়ে আছি পরম বিশ্বাসে।’ [‘নষ্ট জ্যোৎস্নার ক্যারাভানে’]। তাঁর কবিতা নানাভাবে ছুঁয়ে যায় আমাদের জীবন। প্রতিবাদী কবিতা হয়েও যেন শান্ত–শীতল আবেশে নিজ আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করার প্রয়াসে ছুটে চলেছেন কবি। রাজনীতি থেকে রাষ্ট্র দিনকে দিন বিচ্ছিন্ন হচ্ছে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর নানান ব্যঞ্জনায়। কবি চেয়েছেন এসব বুদ্ধিজীবীর নাশ হোক, বিনষ্ট হোক মিডিয়াদেবীর অতিরঞ্জিত তোষামুদের জটিল পথ। এই নামেমাত্র পলিটিক্সের গুরুত্ব লেখকের কাছে একেবারেই মূল্যহীন। কবি ক্রোধের বহ্নিতাপে নেমেসিসের আগমন প্রত্যাশী, এমনকি মানব কল্যাণে বিলীন হতে লালনের মানবতার একতারা নিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন ভবিষ্যত দিশারীর প্রতি। সামাজিক মানবিক দায়বোধে, প্রতিরোধ শক্তি সঞ্চয়ে, নব–জীবনবোধে অঙ্গিকারবদ্ধ মননে নবমাত্রা সঞ্চারিত হয়েছে কবিচেতনায়। কবিতাকে প্রয়োগ করেছেন আত্ম অন্বেষণের নিগূঢ় প্রয়াসে:
মৃতপ্রায় ঈশ্বর জেনে–শুনে–বুঝেও নিশ্চুপ থাকেন
ধর্মযুদ্ধের নামে চলে শক্তি প্রদর্শন
সূক্ষ্ম কিংবা স্থুল কারচুপিকে প্রচার করা হয় ‘লীলা’ সম্বোধনে
তারপরও তো জয়ী হয় মানুষ¾
জয়মাল্য ওঠে রাবণ–মেঘনাদ–একিলিসের গলায়।
[দিবারাত্রি প্রেমকাব্য ]
চিরকালীন অভিজ্ঞতায় ব্যক্তি–মানুষ–ই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় বলে বিশ্বাস করেন কবি। নিয়তিকে অতিক্রম করে কবি জয়ী হতে চান। কবি শুভ মুহূর্তের স্বপ্ন বুনতে চান সবুজ বৃক্ষের ন্যায়। কবি ভবিষ্যতকে দেখেছেন শুদ্ধতার চর্চায়¾ ‘পেদ্রো স্যালিনাস, সত্যিই ধরিত্রীতে পোঁতা আছে আমাদের দু’খানি পা/ পায়ের ওপরে শরীর¾ শরীরের ওপরে মাথা¾ মাথার মাঝে কপাল/ কপালের আশ্রয়ে শুদ্ধ মনন¾ শুদ্ধ মননের ভিতরে আগামীকাল।’ [‘শিশুভবিতব্য’, নিশীথপ্রদীপে শঙ্খ ঝিনুকের চাষ]। কবিচিত্ত অস্থিরতার হাত থেকে মুক্তি পেতে আত্মনিমজ্জনের পথে হেঁটেছেন। এই অবস্থা কবিতায় দূরত্ব ও নৈকট্যের সন্ধানে হয়ে যায় অস্পষ্ট, বাইরের পৃথিবী ভিতরের পৃথিবীর সঙ্গে অলিঙ্গন করে চিন্তা অনুভূতির সাথে একাত্ম হয়ে কবির কবিতায়। বিচ্ছেদের হাত থেকে বাঁচার নেশায় কবি আত্মনিমগ্ন হয়েছেন অন্তর্গূঢ় ভাব রচনায়¾ ‘মর্মে মর্মে বুঝি এখন/ অমৃতবচন/ ও যে ঢেকে রাখা/ ঘাস;/ ঢাকা নয়।’ [‘ঢাকার ঘাস সাদা’, সব ঠিক, ঠিক কি, ঠিকটা কী] কবিতায় রয়েছে সমকালীন দেশকালের পরিসরে ঘটনার অতীন্দ্রিয়–অনুভব ও বিজ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা পূর্বের সংজ্ঞা পরিবর্তনের এক স্বতন্ত্র দীক্ষা। এক নিম্নবিত্ত মানুষের গ্লানিময় জীবনে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সাধেরও বর্ণনা নান্দনিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে শ্লেষাত্মক বাক্যের মাধ্যমে। তিনকোণ বিশিষ্ট জিনিসটির নাম গোলজার নামক বয়োবৃদ্ধ মানুষটি জানে না, এমনকি সে জানেও না এই তিনকোণাকৃতি সিঙ্গারার ভেতর আলু কেমন করে যায়! চলমান পৃথিবীর গোলকধাঁধার গল্পটা সহজভাবে বেহেশত–দোযখ–পৃথিবীর আবর্তনে দারুণভাবে ব্যক্ত করেছেন কবি। সেখানে গোলজার মহাশয় শেষমেষ ডালপুরি বুঝে ‘শুদা আলু’ নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে বাড়ি ফেরে। সামান্য আয়ের এই মানুষটির মনস্তাপ মহাকালের নেতিবাচক অভিব্যক্তি হয়ে ধরা পড়ে কবিতার ভাষায় :
অর্ডার মতো গরম সিঙ্গারা সাপ্লাই হবার মুহূর্তকাল পরেই গোলজারের অভিব্যক্তি
আউ আউ বাহে, সিঙ্গারার ভিতরত ক্যামবা আলু…
বাইরের বাহারি কারুকাজে মোহাবিষ্ট হওয়ায় মনে মনে সে নিজেকে গালি দেয়
আর ভুল না করার সিদ্ধান্তে গোলজার মিয়া আবারও অর্ডার করে ভিন্নকিছুর
এ পর্যায়ে গোলজার আর আতকে ওঠে না; শুধু বাড়ি ফেরার সময় বিড়বিড় করে
শালার ডাইলপুরি, ডাইল নাইতো শুদা আলু…
[‘গোলকধাঁধা’, নিশীথপ্রদীপে শঙ্খঝিনুকের চাষ]
সমাজের পতিতাবৃত্তিকেও কবি তাঁর কবিতায় উপজীব্য করেছেন। সমাজবাস্তবতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে নানানরকম অবহেলা, জিজ্ঞাসা ও নাগরিক যাতনার গল্প। ‘উর্বশী’ কবিতায় পথিক সংলাপের মাধ্যমে কথোপকথনের সময় নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে পতিতাকে। পতিতা তাঁর কথার উত্তরে বুঝিয়ে দেয় তার নশ্বর দেহ বিলিয়ে দেয় শুধুমাত্র তাদেরই চাহিদা মেটাবার জন্য। পথিককে দিনের বেলায় সাধু বললেও রাতে যে সে সাহসী করীম হয়ে বেশ্যার কাছেই ফিরে যায় সেটি স্পষ্ট করেছে বাক্যের বিবরণীতে : ‘অজেয় বার্তা ঈশ্বর জানেন¾ পান্থ তোমার সাধ্য নাই।/ অতৃপ্ত আত্মার সেবা করি¾ উর্বশী আমি স্বর্গে ঠাঁই।।’ [নিশীথপ্রদীপে শঙ্খঝিনুকের চাষ] নিজেকে উর্বশী সেবার মত মহান পেশার সাথে জড়িত বলে মনে করে পতিতা। কবি প্রকৃতপক্ষে সাদা–কালো দুদিকের ব্যাখ্যা জানতে প্রয়াসী। প্রত্যেকেই নিজস্ব যুক্তি–দর্শন দিয়ে তার জীবন অতিবাহিত করে। কবি সমাজের এমন অসংগত জীবনকেও কবিতায় ঠাঁই দিয়েছেন দার্শনিক তাৎপর্যে।
কুৎসিত বীভৎসতায় মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখে, ঘুনধরা সমাজ ও ধ্বংসোন্মুখ দেশকে বাঁচাবার জন্য কবি জাগাতে চান জাতীয়চেতনাকে। স্বকালের দাবি না মিটিয়ে চিরন্তনের ছাড়পত্র মেলে না, চেতনায় স্তরে স্তরে আঘাত হেনে কবি সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়েও দিয়েছেন বারংবার। কবির বর্ণনায় :
বোধ বাঁধা পড়ে যখন ব্যবসায়
উপলব্ধি শব্দের অর্থ যখন স্বার্থজ্ঞান
জ্ঞানের মধ্যে ঢুকে পড়ে যখন ভেদবুদ্ধি
জাতি ও জাতীয়তাবাদের মসৃণ মোড়কে পরিবেশিত হয় যখন যুদ্ধের রসদ¾
তখন কী বৃক্ষ বাঁচে!
বনসাই দখল করে নেয় পৃথিবীর চাকচিক্যময় স্থানগুলো
বৃক্ষহীন স্থাপনাগুলো সবুজ হয়ে ওঠে কৌটার রঙে
নতুন পৃথিবীতে নতজানু হয় প্রকৃতি
নতজানু প্রকৃতির সন্তান
মানুষ হয় খর্বাকৃতি!
[‘নতজানু প্রকৃতি ও খর্বাকৃতি মানুষ’, সব ঠিক, ঠিক কি, ঠিকটা কী]
কবি চেতনার তৃষ্ণায় বিস্ময়ে বিস্ময়ে দিনযাপন করছেন ভঙুর পৃথিবীর লীলাখেলায়। দিনবদলের আশায় লেবাসপরা রাজনীতিবিদদের ধিক্কার দিয়েছেন কবি। আজ আর সুর দিয়ে কোনো মাঝি গান গায় না, গাঁয়ের লোকেরা সব হা–ভাতে। এসমস্ত ক্ষুধা–দারিদ্র্য থেকে মুক্তির প্রত্যাশা কবির; অপ্রত্যাশিত পঙ্গুত্বকে অবলীলায় অস্বীকার করেছেন ‘ভাগ্যবানের ভার ভগবানে বয়’ কবিতায়। ‘যে মানুষ আমিত্ব সত্তায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জয় করে চলেছে পথচলার অদম্য নেশা’¾ সেই অদম্যশক্তির দীর্ঘশ্বাস থেকে কুণ্ডলীকৃত নাঙা নীলবাষ্প ভগবানকে একদিন ঠিকই গ্রাস করবে বলে মনে করেন কবি। সামাজিক সংকটকে অন্তরে ধারণ করেছেন বলেই বলতে পারেন : ‘পৃথিবীতে নিরঙ্কুশ ঠিক বলে কিছু নেই/ আছে শুধু নিজ মত, নিজ পথের যুক্তি, আর আছে আজ্ঞে জি!!’ [‘সব ঠিক, ঠিক কি, ঠিকটা কী’, সব ঠি, ঠিক কি, ঠিকটা কী] অনৈতিক দুঃশাসন বেশিদিন টিকবে না, এই সামাজিক গ্লানি থেকে উত্তরণের আশায় উজ্জ্বল হয়েছে কবির চোখ। ইতিহাস–দর্শন–রাজনীতি–সুশীল সমাজ এসব জায়গায়ই কবি খণ্ডিত ও দ্বিধান্বিত সত্তাকে সত্যের প্রতি জাগরিত করেছেন; যদিও নিরঙ্কুশ সত্য বলে কিছু হয় না। তারপরেও স্বীয় বিশ্বাস দিয়ে পৃথিবীর বিচিত্র অসংগতি ও সংকটকে উতরানোর চেষ্টা চলমান থাকার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন কবি মাওলা প্রিন্স।
সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সামাজিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি কবি তাঁর কবিতায় মার্জিত শৈলীর ব্যবহারে প্রেমের মাহাত্ম্য বর্ণনায় উন্মুখ হয়েছেন প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই। প্রেম দ্বারা প্রেয়সীকে যেমন স্মরণ করেছেন তেমনি প্রেম দিয়ে শাশ্বত জীবনবোধের পরিশুদ্ধ রূপও আনয়নের পক্ষে তিনি। প্রেম প্রকাশে শব্দচয়ন, উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং তীব্র–তীক্ষ্ণ শ্লেষাত্মক বাক্যব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর কবিতার ভুবন। কখনও প্রেমের সহযাত্রী হয়েছে নৈঃসঙ্গ্যচেতনা, ইতিহাসচেতনা, আবার কখনওবা সঙ্গী হয়েছে চিত্রকল্পবাচক কবিতাসম্ভার। প্রেয়সীকে ঘিরে নানারকম অব্যক্ত সুখ–দুঃখ, ব্যথা–বেদনাকে সাঙ্গ করেছেন অপ্রতিরোধ্য প্রেমময় আখ্যানে। শব্দ–খেলার মাধ্যমে চিরায়ত প্রেমের পরিশুদ্ধ রূপ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিতায়। প্রেমকে কেন্দ্র করে কবি হৃদয় কখনো মদমত্ততায় বিভোর, কখনো প্রেয়সীর প্রতি আকুল আর্তি, কখনো উন্মাদ, আবার কখনো বিরহে কাতর। কামহীন প্রেমের সংশয় দেখা যায় তাঁর কবিতায়, কবি কাম ও প্রেমের প্রভেদ করেছেন অবলীলায় : ‘কাকে শুধাই¾ কী করে বোঝাই¾ হৃদয় পেলো ক’জন¾ হৃৎপিণ্ড পেলো সবাই।’ [দিবারাত্রি প্রেমকাব্য ] হার না মেনে কবি মেঘবালিকার প্রেমেই পরাজিত হতে চেয়েছেন যুগ যুগ ধরে। কবির অতীত নয়নাকাশে যে প্রেমের উন্মেষ অজস্র বছর পরেও সেটি অম্লান–অক্ষয়। জীবনকে সঞ্জীব করে প্রেম, আর প্রেম দিয়ে সব জয় করা সম্ভব বলে মনে করেন কবি। নিসর্গকে বর্ণনাত্মক করেছেন প্রেমের বহিঃপ্রকাশে, যা কবির আর্তিতে স্থান পেয়েছে প্রেয়সীর প্রতি শ্রুতিমধুর আহ্বানে :
শোন রে সখা শোন্¾ মন আমার গগনশিরীষ বন;
বুকের ভেতর মোমের পুতুল¾ দিবারাত্রি তারই কথন।
[দিবারাত্রি প্রেমকাব্য ]
দিবারাত্রি প্রেমের কথন দিয়ে কবি যতন করে রেখেছেন প্রিয়ার স্মৃতি। কবি বোঝেন যে প্রেম জীবনজাগরণে সমর্থ সে প্রেম শুদ্ধ, পূত–পবিত্র; আর যে প্রেম জীবনকে জাগাতে পারে না, সে প্রেম মিথ্যা প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়। কোনোপ্রকার প্রতিদানের আশা ব্যতীত কবি অজস্র বছর পরেও একইভাবে প্রেমে মগ্ন থাকতে চান। একপাক্ষিক হলেও প্রেমের গভীরতায় কবির অবগাহন চলেছে, প্রেয়সীর সে প্রেম উপেক্ষা করার মত শক্তি নেই¾, এই আশাবাদ প্রেমের কবিতায় দীপ্তি ছড়িয়েছে। প্রেয়সীকে কবি নানা নামে সম্বোধন করে একেকটি রূপের আবির্ভাব করেছেন তাঁর কাব্যকলায়। মেঘবালিকা, জলদেবী, প্রেয়সী, বিজিতা, লজ্জাবতী, সখা, সুমিতা, রাধা, চলন্তিকা, শেফালিকা প্রভৃতি নামে অলঙ্কৃত করেছেন কবিপ্রিয়াকে। কবি সর্বদা অরণ্যদেবী, প্রেমদেবী ও রঙধনুদেবীর প্রতি মিনতি রেখেছেন তাঁর প্রিয়া মেঘবালিকাকে যেন দেখে রাখে–রাঙিয়ে রাখে। ড. বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য কবির জন্য প্রযোজ্য মনে করছি : “কোনো বাস্তব নারীর উপরে সময় বিশেষে নারীপ্রতিমার প্রক্ষেপণ হয়তো প্রয়োজনীয়, হয়তো তা সকল সময় প্রত্যাহার করা অসম্ভব, হয়তো ঐভাবে পুরুষের পক্ষে মূল্যবান কিছু উপলব্ধি ঘটতে পারে, কিন্তু পুরুষের জানা উচিত সেই শক্তির স্বরূপ, যা তাকে অধিকার করে রেখেছে; এই অভিজ্ঞতার ফলে আমাদের চেতনার বিস্তৃতি ঘটবে, আমাদের সত্তা বিকশিত হয়ে উঠবে।” কবিসত্তা এই অভিজ্ঞতায় বিকশিত হয়েছেন প্রেমকে আলিঙ্গন করে। প্রেম না থাকলে বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে যায়। কবি অনুভবের জটিলতাকে অকারণে দুবোর্ধ্য করে তুলতে চান নি; তাই সহজ–সরলভাবে প্রেমপ্রত্যাশী হয়েছেন।
কবি জীবনবিলাসী হয়ে জীবনযন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে জীবনের জয়গান গেয়েছেন। জীবনের বিচিত্র রঙের রোমাঞ্চকর আঙ্গিক নির্মাণ করেছেন; যা তাঁর সৃজনী প্রতিভাকে প্রকাশ করেছে অনেকাংশে। কখনো অন্তরভাষ্যে উঠে এসেছে মিলন নয় বিরহেই প্রেমের স্থিরতা, মিলন যেন জীবনক্ষয়ের কারণ না হয় সে শঙ্কাও কাজ করেছে তাঁর কবিতায়। কবি পাঠকের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছেন অসাধারণ কাব্যিক আবহ সৃষ্টি করে। নিজে থেকেই যুক্তি দিয়ে আবার পাঠককে এক অন্যরকম ঘোরে নিয়ে গেছেন বারংবার। যে বৈশিষ্ট্য কবি তাঁর উত্তরাধিকারসূত্রে থেকে পেয়েছেন। এক্ষেত্রে বিস্ময় হতে পারে, কখনও কখনও কবিবাণীর বিচিত্র প্রকাশ জীবনানন্দ দাশের প্রতিচ্ছায়ায় প্রতিফলিত হয়েছে। চিত্রকল্পবাচক কবিতাগুচ্ছ পড়লে পাঠক মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় জীবনানন্দের চিত্ররূপময়তার সেই বর্ণনায়। প্রতিবেশের ক্ষেত্রবিশেষে একই উদ্দীপকের ভিন্ন ভিন্ন কবি বিচিত্র বৈশিষ্ট্যে উপস্থাপন করেন স্বীয় কাব্যপ্রতিভা। কবি মাওলা প্রিন্স এর ব্যতিক্রম নন। উপমার ব্যবহারে কিছু কিছু শব্দের দিত্ব ব্যবহার বিষয়ীর অলোকে হয়েছে উদ্ভাসিত। যেমন :
ঘুমের ভেতর ভর করে অনিমেষ বৈদ্য।
রাঙা প্রিয়ার রাঙা ঠোঁটের মতন
মদ ছেড়ে
একদিন বিষণ্ন বেলায়
পথ ভেঙেছিলাম সিগিরিয়ার পথে;
[‘অনিমেষ বৈদ্য’, আবার বছর কুড়ি পর ]
অথবা,
বিমুগ্ধ চোখ ছিলো
হাজার রাতের স্বপ্ন জমানো;
এখন মেয়েটির মতন
সিগিরিয়া কিংবা কাঞ্চনজংঘার রূপ আর মনে নাই
কুড়ি বছর পর;
[‘শঙ্খবালিকা’, আবার বছর কুড়ি পর ]
‘নরম রোদের গন্ধ’, ‘বিকেলের নরম রোদ’, ‘বিকেলের ঝরা আলোর ওম’, ‘সবুজ–সরস্বতী’, ‘গগণশিরীষবন’, ‘পৌষের গাঢ় কুয়াশার ওম’, ‘পৌষের মলিন শীত’, ‘কার্তিকের হিম’, ‘শরতের ঝরা মেঘ’ প্রভৃতি শব্দের বারংবার ব্যবহার কাব্যশরীরকে করেছে অলঙ্কৃত। বর্তমান প্রতিবেশে কবিতায় এমন শব্দের খেলা বিরল। আবার বছর কুড়ি পর কাব্যটির প্রায় সবজায়গায় কবি জীবনানন্দ দাশকে স্মরণ করেছেন। প্রতিটি কবিতায় জীবনানন্দের প্রিয়া, প্রকৃতি, নিসর্গপ্রীতি উঠে এসেছে চমৎকার বর্ণনায়। প্রিয়ার রূপ অঙ্কিত হয়েছে উপমার স্বাতন্ত্র্য প্রকল্পনায়; প্রিয়ার হৃদয়ের গভীরতা বোঝাতে দূরতম দ্বীপের তুলনা করেছেন, যেখানে আলো পৌঁছাতে হয়ত যুগ যুগ সময় লাগে। কবির চেতনায় নির্বাক সুভাষিণী তাঁর প্রিয়া; কারণ, প্রিয়ার বিভ্রান্ত ও বিমুগ্ধ চাহনি কবিকে আবিষ্ট করে পাওয়া না পাওয়ার এক দ্বন্দ্ব সম্বলিত প্রেমপার্থনায়। কবি তাই শেষপর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে চান নির্দিষ্ট বিরামে যেখানে দূর থেকেও প্রেয়সীর প্রেমচর্চায় ব্যস্ত রাখা যায় নিজেকে।
প্রতিটি প্রেমেই কিছু না কিছু সম্বোধনসূচক নাম থাকে; কবির অভিপ্রায় তাঁর প্রিয়া যেন তাকে “রাজকুমার” বলে ডাকে। স্বগতোক্তিতে বিবৃত হতে থাকে কবিআত্মা¾
কতো কাল তুমি হাসিভরা মুখে কিংবা ব্যথাভরা কণ্ঠে বলো না, ‘রাজকুমার¾’
কতো কাল ঔৎসুক্য তুমি জিজ্ঞেস করো না, ‘কেমন আছো¾’
তোমার উজ্জ্বল অনুসন্ধানী–চোখ কতো কাল খুঁজে না
আমার চোখের চাঁপা আর্তনাদ কিংবা গোপনতম রহস্য¾”
[দিবারাত্রি প্রেমকাব্য ]
কবি প্রেমে দিশেহারা প্রাণ; ঠিক কেমন করে প্রিয়া তাঁর মননক্ষুধা মিটাতে সক্ষম সে পরিকল্পনা কবিতার পরতে পরতে বিস্তৃত। কবি আবার নিশ্চিন্তও বটে¾ “সখি, আমি ভালোবাসি যারে¾ সে–কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।” [দিবারাত্রি প্রেমকাব্য ] প্রেয়সী দূরে গেলেও ফিরে আসবেই আর কবি তাকে ফুলহারে অভিবাদন জানিয়ে স্বাগত জানাবে। জগতের নানা গণ্ডগোলের ভেতর প্রেয়সীকে না পাওয়ার বিচ্ছেদে কাঁদতে নিষেধ করছেন কবি। তার ভাষ্যে, “সই, তুমি কান্দো ক্যান/ কাইন্দো না বিচ্ছেদে¾।/ কান্দে কান্দুক তোমার আল্লা/ রাখলো না যে নসিবে¾।।” [দিবারাত্রি প্রেমকাব্য ] আত্মার প্রেমে বলীয়ান কবি যাত্রা করেছেন অনিশেষ জীবনযাত্রায় যেখানে আমাদের কবি শান্ত–স্নিগ্ধ–নিরুত্তাপ–নিরুদ্বিগ্ন। জীবনাভিজ্ঞতা থেকে কবির সংসার উদাসী পরমতত্ত্বের বোঝাপরায় সাঙ্গ হয়েছে শুধু প্রেম; একমাত্র প্রেমই নতুন করে জীবন জাগাতে সক্ষম।
তিন.
আধুনিক সময়ে কবিতার এমন মন্ত্রমুগ্ধ প্রকাশ খুব কম দেখা যায়; মাওলা প্রিন্স কবিয়াল থেকে কবি হয়ে উঠেছেন তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থে। আধুনিক ভাবধারাপুষ্ট কবি স্বল্পসময়ের আবর্তনে বিচিত্র বিষয় ও আঙ্গিকে উপহার দিয়েছেন চারটি কাব্যগ্রন্থ। যা পাঠকহৃদয়কে মোহাবিষ্ট করে অচিরেই। পাঠক কখনও ক্লান্ত হয় না তাঁর কবিতা পাঠে; এজন্য পাঠকপ্রিয়তার চরমে উঠেছে মাওলা প্রিন্সের কবিতা। সমকালীনতাকে যেমন ধারণ করেছেন কবি তেমনি অন্তর্গূঢ় ভাবের বহিঃপ্রকাশেও সমান যাত্রা করেছেন কবিতার স্তরায়নে। প্রাতিস্বিক ভাব–ভাষা–বৈচিত্র্যে নিজস্বতাকে নিয়ে গেছেন অসাধারণত্বে, তেমনি কবিতার ধারায় রেখেছেন স্বতন্ত্র আঙ্গিকের স্বাক্ষর। বাংলা কবিতাভুবনের সমৃদ্ধিতে কবি মাওলা প্রিন্স আরো জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থের জনক হয়ে বারে বারে ফিরে আসুক স্বপ্নশালুকের বেশে।
Discussion about this post