ডোরা মিত্র
“মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ— ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ-আবেশ।” রবীন্দ্রনাথের এই গানের লাইনগুলোর সাথে মিলে যায় যে মহান ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ও সাহিত্যিক মাওলা প্রিন্স। তাঁকে আমি “স্যার” সম্বোধন করি শ্রদ্ধার আসনে আসীন বলে এবং আমার শিক্ষাগুরু হিসেবে মানি বলেও এই সম্বোধন। বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি— এই বিশেষ উপন্যাসের স্রষ্টার সাথে আমার প্রথম আলাপ আমি যে কলেজে কর্মরতা সেই কলেজে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা সভায় মূলবক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন তিনি। বিষয় ছিল বাংলাদেশের সাহিত্যে নারীর রূপায়ণ। সময় ছিল ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২২ সাল। সোমবার। যখন তিনি তাঁর বক্তব্য রাখা শুরু করেন সর্বপ্রথম তিনি ছাত্রীদের সাথে এক সেতু তৈরির চেষ্টা করেন। তারপর গল্পকথনের ভঙ্গিতে তাঁর নিজের এবং বাংলাদেশের অন্যান্য কথাসাহিত্যিকদের সৃষ্টির আলোয় নারী-জীবনের অব্যক্ত নানাদিক তুলে ধরেন। আমি সৌভাগ্যবশত স্যারের অমায়িক ব্যবহারে সাহস পেয়ে ছাত্রীদের ও তাঁর মধ্যে সাঁকো তৈরিতে এগিয়ে যাই। তিনি নীরবে আমার স্পর্ধায় সম্মতি প্রদান করেন। আমিও অনেকদিন বাদে ছাত্রী হয়ে উঠেছিলাম। স্যার তাঁর সাথে যোগাযোগের কার্ড দিয়ে যান। পরবর্তীতে তাঁর সাথে যোগাযোগ হয় দূরভাষে, তাঁর এক যোগ্য ও প্রিয় ছাত্র আমার পরম প্রিয় ভাই জুবায়েদের মাধ্যমে এবং কলেজে আমার কলিগ ও ভগ্নিসমা চন্দ্রাণীর সূত্রে। তাঁর বিবিধ লেখালেখি, অমোঘ সৃষ্টির সাথে পরিচিত হই। তাঁর সুগভীর মননের সাথে আরো গভীরভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। স্যারের পাঠানো তাঁর লেখা “এক কথা একশো বার” পড়ে আমি আজ তাঁর শিষ্যা। আমার কাছে তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, অন্নদাশঙ্করের মতো মহাপুরুষদের মতোই প্রণম্য ও আরাধ্য। এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও অনুভূতি ও বোধের উপজাত ভাবধারার দ্যুতি; যার মধ্যে এতোটুকু বাতুলতা নেই। তাঁর কথায়, “ওঁরা আমার দেবতা”। ওঁদের মতো বোধিসম্পন্ন আমার কাছে তিনিও। সত্যের আলোয় গড়া তাঁর বাণীরূপ অধরা থেকে যেত যদি না তাঁর সান্নিধ্য পেতাম, যদি না তাঁর সৃষ্টির অতলে তাঁরই নির্দেশে ডুবুরি হতাম। মণিমুক্তা কতোটা চয়ন করতে পেরেছি আগামী বলতে পারবে, আর স্যার পারবেন। আমি অসম সাহসী হয়ে তাঁর সর্বাধিক দুর্গম ও অসাধারণ বোধিপাঠের উপন্যাস “বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি” নিয়ে মুক্তগদ্য লেখায় প্রয়াসী হয়েছি। পাঠক ও তাঁর ছাত্রী হিসেবে এই গুরুদায়িত্ব কতোটা পালন করতে পারলাম, তা স্যার ও গুণীজন ও পাঠক বলতে পারবেন। আমার বিনীত আন্তরিক অনুরোধ যে ভুল-ত্রুটি যা কিছু সব নিজ গুণে প্রত্যেকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি তাঁকে যতোটুকু বুঝেছি হলফ করে বলতে পারি তিনি বিশেষ এবং বিশেষের মাঝে সবিশেষ। কারণ, তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে বড়ো দিক, মানুষটির নম্রতা ও বিনয়। ভূমিপুত্র স্বরূপে বিকশিত তাঁর মন, মনন ও ব্যবহার তাঁকে সবিশেষ করেছে বলে আমার মত এবং দৃঢ় বিশ্বাস। আর তাঁর এই উপন্যাসটিও এই শতাব্দীর এক বিশেষ ও সবিশেষ কথাসাহিত্য; যা জীবনানন্দের সৃষ্টির মতোই অগণিত পর্যায়, ধাপ ও দীর্ঘ এবং অগণিত বাঁকবদলের চেতনক্রমে সমৃদ্ধ। অসীমের পথে এগোনোর মতোই এক দীর্ঘ, দুর্গম পদচারণায় যেন বহুবাস্তবিক বিষয়ের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নির্জন নীহারিকা প্রাপ্তি। গন্তব্যে পৌঁছোনো নিশ্চিত নাও হতে পারে জেনেও গন্তব্যে পৌঁছোনোর তীব্র টান ও ঘূর্ণির সৃষ্টি। তাই আমি এই মুহূর্তে উপন্যাসের একাংশের নামকরণ ও পটভূমির উৎস সন্ধানের পথে পাড়ি জমিয়েছি এবং প্রথম পর্বের সীমান্তে সীমাবদ্ধ রেখে স্যারের উপন্যাসের প্রতি যথাযথ আলোকপাত করার আমার সাধ্যমতো প্রচেষ্টা করেছি।
২.
আমার কাছে কথাসাহিত্য জীবন, জগৎ, প্রকৃতি সবকিছুর থেকে জারিত জান্তব জৈবিক ও যৌগিক অনুভূতি ও উপলব্ধির জারক রসে সিক্ত শৃঙ্গার। যার মধ্যে বিরাজমান মানুষ ও প্রাণীকূল এবং প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণময় অঙ্গরাগ আর পঞ্চরসের নানা বিচিত্র ও বিষয়ান্তিক দ্যুতি। যার ছটায় বা বিচ্ছুরণে প্রকাশ পায় মহাবিশ্বের নানা বিস্ময়, সমাজ, সময়, রাষ্ট্র, অর্থ, মনস্তত্ত্ব, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস, ইত্যাদি নানা বিষয়ের সহাবস্থান। কখনো বিরোধ, কখনো সমন্বয়, কখনোবা সংমিশ্রণ, আবার কখনো লৌকিক, অলৌকিক, রহস্য, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব এরকম বিচিত্র ভাবনা, শৈলীর প্রতিক্রিয়াশীল মৌলিক ভাবধারার সংশ্লেষ ও পরিক্রমণ। এর নানা রঙের বাস্তবিক ছবি, স্রষ্টার মৌলিক, তার সাথে কিছু কল্পনা, কিছু ক্ষেত্রে শুধুই নির্মম সত্য ও জান্তব ঘটনা ও উপলব্ধির সরাসরি বাস্তবতার বয়ান। আমার আলোচ্য উপন্যাস মাওলা প্রিন্সের লেখা “বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি” উপন্যাসটি।
উপন্যাসটি শুরুই হয়েছে একটি বিশেষ অথচ নির্দিষ্ট করে দেওয়া সংক্ষিপ্ত বাক্য দিয়ে, যা একটা বড়ো ধাক্কার আবহ তৈরি করে। পাঠকের থমকে গিয়ে সচল হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। বাক্যটি হলো “মৃতেরা ফিরে আসে।” এই রেটোরিক উপন্যাসটি যে বাস্তব চেতনাসমৃদ্ধ লেখকের, তার ইঙ্গিত দেয়। কৌতূহল বাড়ে। কিভাবে মৃতেরা ফিরে আসে? আসলে কিভাবে আসে? কখন আসে? ইত্যাদি নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমিও এই কৌতূহল, প্রশ্ন, বিস্ময়ের সম্মুখীন। উপন্যাসের নিবিড় পাঠের গভীরে প্রবেশ করতে করতে এক দুর্গম মৃত্যুপ্রদেশে প্রবেশ করি। কারণ হিসেবে প্রথমেই বোঝা যায় উপন্যাসের সময়কাল করোনার মতো অতিমারীর বিভীষিকার রুদ্ধশ্বাস মৃত্যু-উপত্যকার গুপ্তঘাতক ভাইরাস আর মৃতদেহের সঞ্চরণশীল ভয়, ত্রাস আর নির্জন নির্জীব অন্ধকার দিকবিভ্রম পরিস্থিতি বিশ্বময়। সেইসাথে গৃহকোণে আবদ্ধ এক জীবন, শুধুই অপেক্ষা, কবে এসব থেকে মুক্তি, কবে এই জগৎ জুড়ে ঘটে চলা মৃত্যুলীলার অবসান, কবে গৃহকোণ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের শুরু? উত্তর কালের হাতে ছিল জেনেও এক দমচাপা নিদারুণ সুস্থ জীবনের অপেক্ষা। এই দমচাপা অসহায় নিদারুণ সময়ের এক যথাযথ আবহ সৃষ্টি করেছেন বা তাঁর কলমের জান্তব আখরের ক্ষমতায় সেই সময়কে, সেই সময়ের দগ্ধতাকে ছবির মতো সচল করেছেন নিপুণ পর্যবেক্ষণ, স্বচ্ছ মনের অধিকারী, জীবন ও জগতের প্রাঞ্জল রূপকার, বাগ্মী কথাসাহিত্যিক মাওলা প্রিন্স তাঁর নিপুণ লেখনীর স্রোতম্বিনী ধারায়। একেবারে প্রথম অংশ থেকে কিছু অংশ তুলে ধরলে বিষয়ের গভীরতা ও আমার বক্তব্যের বিষয়ও স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হবে। যেমন- উপন্যাসের শুরুতে ঔপন্যাসিক শুরু করেছেন এইভাবে :
মৃতেরা ফিরে আসে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনের নিষ্প্রভ দিনগুলোয় উৎকণ্ঠা আর বিষণ্ণতার মাঝে শ্বাশত রূপালী চাঁদ কিংবা সদ্যোন্মুখ সবুজে মোড়ানো সরস কলাপাতার মতো উঁকি দেয়া মুখগুলো কি সুস্থির, কি শান্ত! মনেই হয় না ওরা নিভে গেছে, ওরা এখন নেই, ওরা অনেকেই চলে গেছে অনেক বছর, ওদের পায়ের চিহ্ন মৃত্তিকা বুকে রাখে নি, মুছে ফেলেছে। ওদের হাসি কিংবা কান্নার শব্দগুলো পৃথিবীর কোথাও আর পাওয়া যাবে না। ওদের হাতে একদিনের রোপিত আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, নিম কিংবা মেহগনির দীঘল ছায়াতলে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ হয়তো দীর্ঘশ্বাসসহ বলবে, বলতে পারে, বড় ভালো ছিলো। দোয়ারি আছিলো। হাসিখুশি মানুষ আছলো এ্যাকটা। আহা, অমন সুন্দর জুয়ান ব্যাটামাইনষের মরণ মানি ন্যাওয়া যায় না! গাবুর ব্যাটার মরণ কোনো বাপে সইহ্য কইরবার পারে! (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ৭)
দক্ষ কথাসাহিত্যিক মাওলা প্রিন্সের মনন ও পর্যবেক্ষণ এবং তাঁর উপন্যাসের পথপ্রদর্শন ধরে আরো কিছুটা এগোলে যে চিত্র ফুটে ওঠে তা বিভীষিকাময়, ভয়ার্ত ও মৃত্যু উপত্যকার গুপ্তঘাতের শঙ্কা জড়ানো। তিনি লিখেছেন :
বহু মানুষের ভীড়। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ কেউ জটলা করছে, কেউবা নীরব, এক-দুই কিংবা তিন জন কাঁচা বাঁশ কেটে খুঁটি-খাটিয়া-মাচা তৈরি আর কবর খননের আচার-আয়োজনে আবিষ্ট। নারীকণ্ঠের বিলাপ, পুরুষকণ্ঠের আর্তনাদ, কিংবা, কোরআন শরীফ পাঠের মিহি সুর স্পষ্ট কানে ভাসে, ভাসবে। […] আমরা সবাই মরে যাবো, আর পনেরো কি ত্রিশ কী পঁয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে সবাই মারা যাবো। আমাদের মৃত্যু হবে। আমাদের মধ্যে সবার মৃত্যু হবে না হয়তো, এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান তাই বলে, কিন্তু, একটা বিশাল ক্ষতি হবে ঘনবসতির এই দেশে। টেলিভিশনে আর পেপার পত্রিকায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যে বারবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলে, বলেন, ছয় বা তিন ফুটের সামাজিক দূরত্বের কথা বলে, বলেন, আলাদা ঘর আর আলাদা টয়লেট ব্যবহারের কথা বলে, বলেন, বলছেন; তা তো ইউরোপ কিংবা আমেরিকা অথবা অস্ট্রেলিয়াতেই সম্ভব। স্বাস্থ্য পরামর্শগুলো যেনো ওদেরই পরিচিত পরিবেশের প্রেসক্রিপশন আর পরামর্শের প্রতিধ্বনি। কিন্তু, অমন সাজানো-গোছানো উন্নত দেশগুলোও তো কোভিড-১৯ করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পাচ্ছে না। উল্টো দিনকে-দিন কাবু হচ্ছে। দিন পেরুলে দুই-তিন-চার হাজার করে জ্যান্ত মানুষ শামিল হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসহায় এক মৃত্যুর মহামিছিলে। সময়টা অদ্ভুত। এমনটা কেউ কখনো দেখে নি। পৃথিবীর সব দেশ সব মানুষ এক নিয়মে ঘরবন্দী, এক ভাবনায় আচ্ছন্ন, এক শঙ্কায় শঙ্কিত, এক আতঙ্কে আতঙ্কিত, এক গবেষণায় নির্ঘুম। […] জীবন এখন সীমিত। জীবিকা এখন শিকায় তুলে রাখা সংরক্ষিত বাতাসা-সন্দেশ। ভরদুপুর এখন গা ছমছম করা অশরীরী ভূত-প্রেতময় এক অমাবস্যার দীর্ঘায়ত রাত। সন্ধ্যা মানে নিজ ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে যেনো বেতারে মুক্তিযুদ্ধের নিষিদ্ধ কথিকা শোনা। আর, রাতটা হলো অবসাদে ভরা দুশ্চিন্তায় ঠাসা এবড়ো-খেবড়ো দীর্ঘতম পথের সমান। সব মানুষ এখন মুখ ঢাকে, পর্দা করে, পাক থাকে। […] ০৮ মার্চ ২০২০। বাংলাদেশে প্রথম কোভিড করোনা রোগী শনাক্ত; ইতালি ফেরত দুজনসহ মোট তিন জন। প্রথম শনাক্তের দশম দিনে ১৮ মার্চ ২০২০ প্রথম একজনের মৃত্যু। (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ৭-৯)
উপন্যাসের শুরুতে লেখকের “মৃতেরা ফিরে আসে।” —এই বাক্যের জীবন্ত রূপচিত্রাঙ্কন কেন, তার ব্যাখ্যা লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন। অনেকের শুরুতে মৃত্যু এবং মৃত্যুর বর্ণনা মনে করিয়ে দেয় আচমকা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর “লালসালু” ও কাঁদো নদী কাঁদো” উপন্যাস ও তাতে বহমান চেতনাপ্রবাহরীতির কথা। কিন্তু, ধাপে ধাপে উপন্যাসের অন্দরমহলে প্রবেশের সাথে সাথে বোঝা যায় লেখক মাওলা প্রিন্স মৃত্যুর অধীন সময়, দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি, বিশ্ব, এবং এই সময়াধীন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মতামত ও কথন স্থানীয় উপভাষার সহায়তায় প্রাণোজ্জ্বল করে ফুটিয়ে তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে লেখক কোনো এক পরিচিত মেজবৌ ও তার পরিবারের সদস্যদের জীবন-যাপন, মৃত্যু-পরিহাস সব ব্যক্ত করেছেন। যেসময় মৃত্যু যেন স্বাভাবিক, বেঁচে থাকা অবাক সবাক বিস্ময়ের বিষয়, সেখানে লেখকের উপন্যাসের নামকরণ এর প্রথম অংশ “বেঁচে থাকাই যুদ্ধ” সার্থক বলে মনে হয় আমার। সেইসাথে মেজবৌ মনে করিয়ে দেয় হাসান আজিজুল হক রচিত “আগুনপাখি” উপন্যাসের কথা। মাওলা প্রিন্স মহাশয় যে হাসান আজিজুল হক এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর যোগ্য উত্তরসূরি এবং যোগ্য উত্তরাধিকার বহন করছেন, তা বলাই বাহুল্য। যদিও এই উপন্যাস বহুমাত্রিক বিষয়, দৃষ্টিকোণ ও বাস্তবসত্য ঘটনা ও লেখকের সহিতের দায়বদ্ধতার অধীন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
৩.
বিবর্তনশীল জগৎ ও সময়, সমাজ ও মানবজীবনের হরেক রঙের বাস্তবিক বয়ানগল্প বলে যাওয়ার বা কথোপোকথনের ভঙ্গিতে সাহিত্যিক মাওলা প্রিন্স তাঁর এই আত্মভাবধারা সমন্বিত সমীক্ষা ও আখ্যান প্রতি পদে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির দ্বন্দ্বে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ক্রম-অধঃপতনের বাংলাদেশ অর্থাৎ লেখকের স্বরাষ্ট্র এবং সমগ্র বিশ্বের অন্তরে-বাহিরে রিক্ত, নিরালম্ব ও সর্বস্বান্ত বিবমিষার মাঝে নিজের সাথে নিজে ক্রমাগত যুদ্ধ করে গেছেন। এবং বারে বারে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। আর, দুর্গম জীবন ও মৃত্যুর অমৃতপাত্রে গরলের অবস্থান অধিক পরিমাণ উথাল-পাথাল দেখে লেখক ধাক্কা খেয়েছেন, চুরমাচুর হয়েছেন, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আবার ইতিবাচক ভাবনার সরলীকরণের পরিবর্তে শুধু এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন ‘বেঁচে থাকার নাম যুদ্ধ’; তবে, শান্তির পৃথিবী কোথায়!? ‘শান্তি’ শব্দের অকালমৃত্যুর অভিসার কেন সর্বত্র!? তাই এই উপন্যাস পাঠে বারে বারে হোঁচট খেতে হয় এই উপন্যাসের কন্টিনুয়াস বা একটানা অসীম ব্যাপ্ত সঞ্চরণশীল আবার এক গভীর তীব্র গতি ও না শেষ হওয়া ব্রেদলেস অটো-টিউনিং এক পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় ক্রিয়াশীলতার জন্য। আর, এসবই আমার একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও অনুভূতি সঞ্জাত পাঠ-প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া। তাঁর লেখা থেকে বিষয়টা আরো স্বচ্ছ করার চেষ্টা করছি। উপন্যাসের যে-কোনো জায়গা থেকে পড়া শুরু করলেও উক্ত ক্রমাগত তথা কন্টিনুয়াস বা একটানা গঠন শৈলী এবং পঠনশৈলী (আমার একান্ত ব্যক্তিগত মনন ও চিন্তন অনুসারে) বুঝতে অসুবিধা হয় না বা হবে না। যেমন দেখুন তাঁর উপন্যাসের ৩৬ নং পেজে দেখা যায় তিনি একটি বিশেষ সময় উল্লেখ করে লিখেছেন :
১৫ এপ্রিল ২০২০ তারিখটা ছিলো ভয় ঘনীভূত হয়ে নাই হওয়ার একটি দিন। ডাক্তাররা চিকিৎসা দিচ্ছেন না, কোথাও কোনো ডাক্তার-বদ্দি-কবিরাজ নাই, ডাক্তাররা হ্যাগোর রমরমা ব্যাপসা ছাইড়্যা দিয়্যা ইন্দুরের লাহান গত্তের মইদ্যে হুগছে, চারিদিকে যখন এরকম রব, মহারব, তার মধ্যেও এই মহামারীতে ডাক্তাররাই হলেন আশ্রয়ের প্রতীক; ডাক্তার যে মানুষ, তাদেরও যে ভয়-ডর কিংবা পুত্র-পরিবার আছে, তারও যে রোগ-বালাই হতে পারে, এটা যে স্বাভাবিক, যেনো এটা আমাদের ধারণার বাইরে চলে গিয়েছিলো, গেছে; এই দিনে করোনায় আমরা প্রথম একজন চিকিৎসককে হারালাম, কর্মরত চিকিৎসক, ডাক্তার মানুষ মইরা গ্যালো আংগোর কী হইবো! সত্যিই তো, সাধারণের কী হবে! যে ডাক্তার সমাজ অথবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার নিজ সন্তানের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারে না, মুমূর্ষু সন্তানকে তড়িৎ সেবা দিতে এগিয়ে আসে না, সেখানে অন্যদের কী হবে! তুই ক্যামোন আছিস, হাসপাতালে যাইস, এ্যাতোদিন তো নিজেদের নিয়্যাই ভাবতাম, কিন্তু, এ্যাখোন তোদের নিয়্যা ভাবছি, তোরা হলি আমাদের আশ্রয়, ভরসা, তোরাই যদি আক্রান্ত হইস, মরে যাইস, তালে আমরা যাবো কৈ? তুই আগে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করিস, তারপর আমাদের চিকিৎসা দেইস, তোর বৌও ডিউটি করছে? হ্যাঁ। তোদের হাসপাতালে রোগী আছে, পিপিই আছে, পেপারে দেখলাম, দুই-একদিনের মধ্যে তোদের ওখানে পিসিআর ল্যাব চালু হচ্ছে? হ্যাঁ, যন্ত্রপাতি আসছে, সেটের কাজ চলছে, তিন-চারদিন লাগবে চালু হতে। তোদের হাসপাতালে রোগী ক্যামোন? আছে, করোনা রোগীর নমুনা নিয়্যা এখন আমরা ঢাকায় পাঠাই, কয়দিন পরে ওরা রিপোর্ট দ্যায়। পিপিই-মাস্ক সঙ্কট আছে, না-কি নাই? কী আর কবো, এটা হলো চোরের দেশ, লিখে পাঠায় পাঁচশো, প্যাকেট খুলে দেখা যায় দুইশো, থাকে না, দুদিনেই শ্যাষহয়। তোরা নিজেরাও তো কিনতে পারিস, তোদের জীবন তোদেরকেই তো নিরাপদ রাখতে হবে? ওসব প্রটেকশন ইক্যুবমেন্ট সব জায়গায় পাওয়া যায় না, আর, নিজে কিনেও পোষাবে না। দ্যাখ, তোদেরকে ভালো থাকতেই হবে। বন্ধু আমার হাসলো। মুঠোফোনে দুফোঁটা হাসির শব্দ শুনলাম, গড়িয়ে পড়লো ফোঁটা ফোঁটা উষ্ণ হাসি! হে সিলেট ওসমানি মেডিক্যাল কলেজের আত্মোৎসর্গী চিকিৎসক মইনউদ্দিন, তুমি কান পেতে আর একবার শোনো, উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই! দিনগুলো যাচ্ছে, তারিখগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে, মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যাগুলো জুয়ার মেশিন ক্যাসিনোর গতিতে লাফাচ্ছে, নর্তকীর ঘুর্ণিনৃত্য শুরু হয়েছে, নটরাজ হো-হো-হো করে হাসছেন, শুরু হলো ঐ তাণ্ডব-ত্রাস—, শুরু হলো ঐ তর্জন-গর্জন-বর্ষণ, ছাদে ছাদে মাঠে মাঠে পথে ঘাটে শুধু শকুনের ছায়া, পৃথিবীতে আজ মৃত মানুষের মাংসখেকো মহাশকুনের মহা-উল্লাস—! ভাবছি, বাড়ি গিয়ে এবার পারিবারিক গোরস্থান বা কবরখানাটা সংস্কার করতে হবে, আরও দু বা তিন শতাংশ জমি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে, এতগুলো মানুষ, মানুষতো আরো হবে, আরও আসবে, জায়গা এখনোই বাড়ানো ভালো! অনেকদিন ধরেই ভাবছি, দিদি বা দাদির কবরটা কোন দিকে হবে, কোন কোণে, আম কিংবা নারিকেল অথবা লিচু গাছের ছায়ায়, না-কি নতুন অংশে, দিদি বা দাদির কবরের পাশে কার কবর হবে, আব্বুর, না-কি আমার, একদিকে আব্বুর আর একদিকে আমার জন্য জায়গা রাখলে কেমন হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আমার স্ত্রী-সন্তানদের জায়গা কোন দিকে হবে? আবার ভাবছি, আমাদের দাদি বা দিদি বা দিদিমাই যে আগে মারা যাবে, যাবেন, কে জানে; আব্বুও তো অসুস্থ, রিটায়ার্ড করেছে কতো আগে, স্ট্রোক করেছে দু-দুবার, হাঁটে একটু খুঁড়িয়ে, কথা বলে একটু দম নিয়ে, থেমে থেমে, রাগ করলে কাঁপতে থাকে! আবার, ভাবছি, বয়স আর অসুস্থতা দিয়েই কি মৃত্যুক্ষণ কিংবা মৃত্যুকাল গণনা করা যায়, বড় বাড়ির কিংবা পুরান বাড়ির মেজো বউ, অর্থাৎ, আমাদের আম্মু তো বয়সে কতো ছোট ছিলো, ছিলেন, অসুস্থ ছিলো এমনটা কেউ কোনদিন ভাবে নি, সে-ই কিংবা তিনিই তো কতো পরে এসে কতো আগে চলে গেলেন! দিব্যি সুস্থ মানুষ, সুদর্শন যুবক, বৌয়ের মেহেদি রাঙা হাতে চা পিয়ে অফিস যাওয়ার পথে বিআরটিসি বাসের নিচে চাপা পড়ে মটরসাইকেলসহ গুঁড়ো হলো, হলেন; ফসলি জমি কিংবা ষোড়শী প্রিয়ার টানে দোলাবাড়ি গিয়ে আইএ রেজাল্ট প্রত্যাশী কচি মিষ্টি ছেলেটি ধরা পড়লো যমের হতে; আবার, ভাত বারেক, এ্যালায় আইসোং, দ্যাখোং কামলাগুলা কী করে, ধান খ্যাতোত্ কাম করে, না খালি বিড়ি খ্যায়, বলে বাড়ি সংলগ্ন ধানক্ষেতে গিয়েই হার্টফেল করে শুয়ে পড়েন বা পড়লেন আমাদের মধ্যবয়সী অতিথিপরায়ণ খালু! আমার কিংবা আমাদের বোন দুটো? কদিনই বাঁচলো, পৃথিবীতে কেনোবা আসলো, কেনোইবা চলে গেলো! একটা দীর্ঘশ্বাস রেখে যাওয়ার জন্য, একটা কান্নার ধারা, কিংবা, বিষাদের নহর বইয়ে দেওয়ার জন্যই কি ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত স্বর্গশিশু ওরা পৃথিবীতে আসে, যায়? এছাড়া ওদের আর কোনো কাজ ছিলো না, একটা মায়ায় জীবিত মানুষদের মেরে ফেলার জন্যই হয়তো ওরা স্বর্গ-বেহেশত থেকে মর্ত্য-পৃথিবীতে আসে, মায়ার বীজ রোপন বা বপন করে হেসে খেলে চলে যায়, ফিরে যায়! জানো, আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি তখন একটি মেয়ে আমাকে তার ভালোবাসার কথা বলেছিলো, ছোট্ট মেয়ে, স্কুলে পড়তো, এইট থেকে সবে নাইনে উঠেছে, উঠেছিলো; রসের সন্ধান যারা করেছিলো, তারা আমাকে বুঝিয়েছিলো কিংবা বোঝাতে চেয়েছিলো, ছোট্ট নয়, এইটাই ঠিক আছে, প্রেমে বা বিয়েতে ছেলে ও মেয়ের বয়সের ব্যবধান এইটাই সঠিক, তুমি বা তুই বা আপনি রাজি হও বা হ বা হন! মেয়েটির চাপল্য ভালো লাগলেও মন বলতো, একরত্তি, বড্ড ছোটো! ভিতরে একটা পণ ছিলো, গণ্ডি পেরুবো, চৌকাঠ ভাঙবো, খুটিতে বাঁধা প্রাণির পৃথিবী দড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ! হৃদয়ের কোনো তন্ত্রীতে যেনো বীণা বাজতো, মিহি, কান পেতে শোনার মতো, শুনতাম, শুনতাম, শুনতাম; তোমার চোখের সন্ধান যে বহু পূর্বেই পেয়েছিলাম, তোমার মুখের মিষ্টি ভাষা যে আমার চেনা, শুধু এক-দুই-তিন বছরের নয়, বহুদিনের চেনা! যাকে মনে ছিলো না, যার অভিমানী কান্নার ধ্বনি কোনোদিন মনে রাখি নি, মনে হয় নি, কী বিস্ময়, আজ এই আতিমারী মহামারী করোনার করাল কালে তারও কান্নার শব্দ টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়ে, পড়ছে, আমি-ই-ই কিন্তু সুইসাইড করবো! আহ্, কী অদ্ভুত, কী অদ্ভুত প্রণয়াবেগ, প্রণয়াকুতি, রক্তক্ষয়ী প্রণয়ে আত্মবিসর্জনের অপূর্ব আখাঙ্ক্ষা, কিংবা, নিষ্পাপ হুমকি, আমি কিন্তু সুইসাইড করবো! বাবা, প্যালেস বানান কি, এস নাকি সি? পি-এল-এ-সি-ই, সি, ক্যানো? তুমি যে বাড়িটা বানাবে সেটার ছবি আঁকছি। ও-ও, ছবির মধ্যে বাড়ির নাম দিবে? মাথা দুলিয়ে এক চিমটি হেসে বললো, হ্যাঁ। ওরা কী নিষ্পাপ, কী হালকা, সফট, সৃষ্টিশীল! এবার মেজো বাবু আসলো, বাবা, তোমার বাড়িটা কী রঙের হবে? তোমাদের পছন্দ অনুযায়ী একটা রঙ করো। না, তুমি বলো। আচ্ছা, বিভিন্ন রঙে রাঙাও। ও একটু থমকে গেলো, বললো, তাহলে তো ভালো লাগবে না! অবাক হলাম, এ্যাতো ছোট বয়সে তুই রঙের ভালো-মন্দো বুঝিস, আচ্ছা, কী রঙ দেয়া যায়, কী রঙ, কী রঙ, নীল আর আকাশী…। এটা ভালো লাগবে, বলে ও চলে গেলে ভাবলাম, রঙের রুচিবোধ কিংবা রঙের ঔচিত্যগুণ সম্পর্কে ওদের দৃষ্টি আছে, চোখ খুলেছে দেখছি! মুহূর্তে মনের মধ্যে একটা ঝিলিক পড়লো! ড্রইংরুমে ডিভান খাটে শুয়ে শুয়ে পেপার দেখছি কিংবা পড়ছি, মুঠোফোনের আওয়াজ পাচ্ছি, মেজোবাবু দৌড়ে এসে মোবাইলটা দিয়ে গেলো, বাবা, তোমার ফোন। আসসালামু আলাইকুম স্যার, ক্যামোন আছেন? কীভাবে ভালো থাকি বাবা, আজকে চল্লিশ দিন হলো, ওর তো কোনো খবর পেলাম না, চল্লিশ দিনের চিল্লায় গেলেও তো আইজক্যা একটা ফোন দিতো, কী করি বাবা, কোথায় যাই, কিছু ভাইবব্যার পাচ্ছি না, এখন আমি কী করবো! [চলছে…] (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ৩৬-৩৮)
সুধী পাঠকবর্গ, আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই লেখকের লেখা থেকে ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ পেজের যে দীর্ঘ উদ্ধৃতি আমি তুলে ধরেছি এবং “চলছে” শব্দটা লিখেছি তার দিকে। কারণ, ৩৬ পৃষ্ঠার আগে-পরে, অনুরূপ ৬০, ৬১ ও ৬২ পৃষ্ঠার আগে-পরে এবং উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ অবধি এভাবেই সবকিছু বয়ানের অনর্গল, না শেষ হওয়া অনর্গল দিনলিপির অমোঘ সময়ের দগ্ধতাকে, সমস্ত অভিঘাতের দীর্ঘ দুর্গম ঘটনাকে, ব্যক্তিমানসের নানা ওঠা-পড়ার স্রোতকে প্রবাহিত ক্রমাগত জীবনধারার মহাসমুদ্রের বড়ো ঢেউয়ের মতো না শেষ হওয়া অশেষের সন্ধান মেলে। কারণ, কালের গতির সাথে জীবন না শেষ হওয়া এক সুবিশাল বৃহৎ গ্রন্থ বা বই যার এক অধ্যায় শেষ হলে আর একটা অধ্যায়ের পাতা খোলে বা খুলতে হয়। জন্ম, বড়ো হওয়া, জীবন-মৃত্যু, শিকড়ে ফেরার তাগিদ, হারানো, প্রাপ্তি, জানা-অজানা, দেখা-অদেখা নানাদিক, মুহূর্ত সব যেন সেই মহাসমুদ্রের বড়ো ঢেউয়ের মধ্যে মিশে থাকা ছোট ছোট ঢেউগুলো যেগুলোও বড়ো ঢেউয়ের সাথে ক্রমাগত পাড়ে আছড়ে পড়ে আবার সরে যায়, আবার আছড়ে পড়ে। আর এই প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে। মাওলা প্রিন্সের উপন্যাসের প্রতি লাইন ও প্রতি পাতায় এই প্রক্রিয়া ক্রমসঞ্চরণশীল এবং এই শৈলী বাংলাসাহিত্যে আমার মনে হয় নবতম সংযোজন এবং বিশেষ। আর, এই প্রক্রিয়া ঔপন্যাসিক কখনো সন্তর্পনে, কখনো অবধারিতভাবে গতিধারায় ও অবারিতভাবে বজায় রেখেছেন শুরু থেকে শেষ অবধি। এই পদ্ধতি তাঁর উপন্যাসের নামকরণকে জান্তব এবং উপন্যাসের গাম্ভীর্যকে সত্য ও বাস্তবায়নে সুদৃঢ়তার সাথে প্রতিষ্ঠা করেছেন। স্রষ্টার ইচ্ছাকৃত প্রয়োগনৈপুণ্যে উপন্যাসের সব চরিত্র, কাহিনী, ঘটনা, সময় ক্রমাগত নির্জন ও দুর্গম থাকে, যা এই উপন্যাসের মূল প্রাণভোমরা তা বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে, স্বতোঃসিদ্ধ হয়েছে এবং স্রষ্টার বক্তব্য-বিষয়কে সার্থক সমর্থন করেছে।এদিক থেকে দেখলে নামকরণের অন্তর্নিহিত অর্থ ও তাৎপর্যকে পূর্ণবিশ্বাস- যোগ্য সার্থকতা ও সমর্থন ও ইঙ্গিতময়তাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। সেদিক থেকে নামকরণের মধ্যে যে ব্যঞ্জনা এবং পাঠকহৃদয়ে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশেষ, কখনো পরিমিত, কখনো অপরিমিত রেটোরিক বা ধাক্কার প্রয়োজন, তা সফল ও সার্থক এবং নান্দনিক নির্মাণ ও বিনির্মাণের দিক থেকেও বাস্তবসম্মত হয়েছে ও পূর্ণতা পেয়েছে। লেখকের মানসিক ইচ্ছা এবং তাঁর প্রায়োগিক টেকনিক ব্যবহার যথাযথ ও সঠিক রূপায়ণ এবং ক্রিয়াশীল হয়েছে। স্রষ্টার সৃষ্টিশীলতার অভিনবত্বের প্রয়োগনৈপুণ্যও প্রমাণিত হয়েছে।
৪.
নদীর চর ভাঙা ও চর জাগার মতোই মানুষ, সমাজ, ইতিহাস, রাষ্ট্র, সম্পর্ক সবকিছু সময়ের আবর্তে ঘূর্ণায়মান, যার পুনরাবর্ত ও এগিয়ে চলার কাহিনী চর ভাঙা আর জাগার মতোই অনিত্য। স্রষ্টা তাঁর এই মহাকাব্যসম উপন্যাসের বাঁকে-বাঁকে নিজেকেও ভেঙেছেন, গড়েছেন, নিজেকেও অলক্ষ্যে চরিত্র হিসেবে প্রতিস্থাপিত করেছেন। তাই ফিরে আসে জীবনের সাধারণ ঘটনার সাথে শিকড়ের সম্পৃক্তবোধনের কাহিনী, পাশাপাশি রাষ্ট্র ও নানা দেশ ও মহাদেশের মানবিক নিয়ম উল্লাঙ্ঘন করার জারজ কাহিনী। নাম না জানা কথক আমার বোধের ছোট্ট আয়নার স্রষ্টা, তাই নিজেই যিনি এই উপন্যাসের প্রতিটি অক্ষরে তাঁর করোনাকালীন আবহ থেকে পরবর্তী বেশকিছু সময়ের যাপিত-জীবনের একটা বড়ো অংশ উদযাপন করেছেন নিপুণ পর্যবেক্ষক ও মহাভারতের অর্জুনের মাছের চোখ তীরবিদ্ধ করার মতো দক্ষ দ্রষ্টার স্বরূপে। এই অসাধ্য সাধন বলে দেয় নামকরণের প্রথমাংশে “বেঁচে থাকাই যুদ্ধ” কেন স্রষ্টা নাম রেখেছেন!? উপন্যাস শুরু করেছিলেন “মৃতেরা ফিরে আসে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনের নিষ্প্রভ দিনগুলোয়” দিয়ে; আবার উপন্যাসের ৬৩ পৃষ্ঠায় স্রষ্টা লিখেছেন “এই তো জীবন, অবিরল কান্না কিংবা শোকাহত হওয়ার পুনরাবৃত্তি ভেঙে হেসে ওঠাই তো জীবন; ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনের নির্বাক নিঃশব্দ মুহূর্তে নিষ্পাপ নিঃশর্ত হাসিই তো নতুন জীবনের বার্তা।” স্রষ্টার ইতিবাচক সহিতের দায়বদ্ধতা ও ধর্ম এবং তাঁর লেখার শৈলীর প্রতিক্রিয়াশীল রোটেশন ও তাঁর এই মহাকাব্যসম উপন্যাসটির মহাপৃথিবীর না শেষ হওয়ার তথা যত দিন পৃথিবী থাকবে বেঁচে থাকার জীবনযুদ্ধ থাকবেই।আবার বিপরীতে নামকরণের শেষাংশের “এবং শান্তি”-র চাওয়া, প্রার্থনা এবং খোঁজও থাকবে। যা “নতুন জীবনের বার্তা” দেবে। তাই সুধী পাঠকবর্গ ও স্রষ্টা বুঝতেই পারছেন স্বল্প ক্যানভাসে বা একটি ক্যানভাসে এই উপন্যাসের বহুমাত্রিকতা তুলে ধরা সম্ভব নয়। আমার এই আন্তরিক প্রচেষ্টার খাতা আপাতত বন্ধ কোরলাম। আশা রাখি আমার পর্যালোচনার যা সঠিক বা যথার্থ ভালো লাগার তা আপনারা চিহ্নিত করবেন আর ভুল, ত্রুটি ও আবুঝতা সব নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। মানবসভ্যতার জয় ও মঙ্গল কামনা করে এবং এই অনন্য অসাধারণ উপন্যাসের স্রষ্টাকে আমার আন্তরিক সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে সমাপ্ত কোরলাম। পরবর্তী নানা পর্বে আশা রাখি আবার আলাপন চলবে।
Discussion about this post