মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন
মাওলা প্রিন্স নিরীক্ষাপ্রিয়, বুদ্ধিদীপ্ত ও বস্তুনিষ্ঠ কবি। তাঁর বস্তুভাবনা রোমান্টিক চেতনা-বিচ্ছিন্ন নয়। জীবন বেড়ে ওঠা, জীবনের মর্মার্থ, জগতের নিয়ম-নীতি-প্রকৃতি, রূপ-সৌন্দর্যের বিকাশ-বিনাস— সবই তাঁকে ভাবায়, নাড়ায়, বাড়ায়। জীবনের সাথে সময় যে অন্বিত, সময়ের পরিবর্তনে ঘটে জীবনের যে কতো রূপান্তর— রেখে যায় স্মৃতির জীবন্ত কিংবা ধূসর রেখাচিহ্ন; সবই অক্ষয় স্বর্ণসম্পদ। সে-সত্যই বিশেষ কাব্যকৌশলে শিল্পায়িত করেছেন মাওলা প্রিন্স তাঁর আবার বছর কুড়ি পর (মুক্তদুয়ার, ২০২০) কাব্যগ্রন্থে।
মাওলা প্রিন্স কবি-প্রাবন্ধিক-গবেষক-সম্পাদক-অধ্যাপক— সব পরিচয়ই তিনি মেধা-নিষ্ঠা-আন্তরিকতা-নিরীক্ষা আর সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। নজরুল-জীবনানন্দসহ আধুনিক সাহিত্যপাঠে তাঁর আগ্রহ প্রবল। নিজ লেখায়, বিশেষ করে আবার বছর কুড়ি পর কাব্যে জীবনানন্দ দাশের খানিকটা ভাব-প্রভাব দৃষ্ট হয়। তবে, সামগ্রিক বিবেচনায় স্পষ্ট হয় যে, প্রিন্সের কবিতায় ভিন্ন সুর ও স্বর আছে— যা তাঁকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম। ইতঃপূর্বে প্রকাশিত তাঁর নিশীথপ্রদীপে শঙ্খঝিনুকের চাষ (২০১৩), দিবারাত্রি প্রেমকাব্য (২০১৪) ও সব ঠিক, ঠিক কি, ঠিকটা কী (২০১৯) কাব্যসমূহের সার্বিক সাফল্য মেনে নিয়েও বলতে হয় কবি মাওলা প্রিন্স ক্রমশ প্রচলিত ও নিজস্ব লিখনরীতি ভেঙে নতুন করে গড়ে চলেছেন। আবার বছর কুড়ি পর সে-সত্যের উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
বর্তমান গ্রন্থের কবিতা সংখ্যা চল্লিশ, প্রতিটি কবিতা নয় পঙক্তির। রচনাকাল ২৮ অক্টোবর থেকে ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ, মাত্র এক মাস আট দিন। জীবনের চিরন্তন অনুভূতি-উপলব্ধিকে সীমিত পরিসরে অপূর্ব কাব্যকলায় বেঁধেছেন মাওলা প্রিন্স। অনিবার্য আকর্ষণে একটানা পড়ে ফেলা যায় কবিতাগুলো। পড়তে গিয়ে কবির অনুভব, পাঠকের হয়ে ধরা দেয়। এখানেই কবির সাফল্য নিশ্চিত।
আজকের সময়-সমাজ-প্রকৃতি-মানুষ— কুড়ি বা কুড়ি কুড়ি বছর পর কী ভাবে প্রভাবিত হয়; হতে পারে—; তারই কাব্যরূপ আবার বছর কুড়ি পর। এখানে কবি-জীবন, তাঁর পারিবারিক জীবনের প্রচ্ছন্ন ছায়া আছে—, আছে সামগ্রিক মানবজীবনের রূপ-রূপান্তর। সে-সাথে দেশচিত্র, ইতিহাস-ঐতিহ্যবাহী জায়গা— রামসাগর, সেন্টমার্টিন, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, আঙুরপোতা, দহগ্রাম, তিনবিঘা করিডোর স্থান নিয়েছে কবিতার প্রয়োজনে—; কবির প্রজ্ঞার প্রকাশক হিসেবে।
রূপ-সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আসক্তি চিরকালীক। নারীর রূপে কবি মুগ্ধ। কবি মাওলা প্রিন্স রূপের তুলনায় অপরূপে মুগ্ধ— ‘রূপ তার সরস্বতীর আদল।’ [‘পাতা ছিলো ছেঁড়া’], ‘চন্দ্রভানের মতো রূপ তার।’ [‘সবুজ সরস্বতী’], ‘মুঠোপদ্মর মতো রূপ তার।’ [ঘামের ঘ্রাণ’], কিংবা ‘হৈমন্তির মতো গড়ন—’ [‘অপভ্রংশমালা’] কবিতার ভাবপ্রকাশ কিংবা উপমা-প্রতীকের প্রয়োজনে অনেক কবিতায় চেনাজানা মহৎ ব্যক্তি বা গল্প-উপন্যাস-কবিতার চরিত্র এসেছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-ভালোবাসার ধারক হিসেবে। যেমন : বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, শকুন্তলা, মহুয়া, শৈবলিনী, হৈমন্তী, সুভা, সুরবালা, পার্বতী, বিলাসী, সুভা, তিশনা প্রমুখ।
ভালোবাসা বা ভালোলাগার সুখময় স্মৃতি বছর কুড়ি পর অম্লান আছে কিংবা বিবর্ণ হয়েছে—; পরিণতির দুটো ক্ষেত্রেই পাঠকের কৌতূহল ধরে রাখে। কবি মাওলা প্রিন্স কিন্তু সদর্থক চেতনার লালক। তাই, তিনি ‘যদি আবার’ কবিতায় বলেন :
শেষ হবে না আতুমির গল্প।
কুড়ি কিংবা
কুড়ি কুড়ি বছর পর
হলো দেখা হয় যদি আবার
বিষণ্ন চোখে চেয়ো না
হাসিমুখে বলো কথা;
ব্যথাগুলো গোপনে বুনে দিও সমতলে
সেখানে গাছ হবে;
নারাঙ্গি বনে কাঁপবে সবুজ পাতা—
মাওলা প্রিন্সের কবিতায় চোখ ও চুল বিশেষ অনুষঙ্গ রূপে উদ্ভাসিত। যে চোখে দেখেন তিনি ‘জীবনের গাঢ় রঙ’, সেই তিনিই দেখেন অন্যের চোখে অন্যমাত্রিক রূপচিত্র :
ক. পাথরের মতো চোখ তার। [‘অপভ্রংশমালা’]
খ. পার্বতীর মতো চোখ তার। [‘নক্ষত্রের মতো’]
গ. চোখ তার বিভ্রান্ত মেঘের বাড়ি। [‘বিকেলের ঘুম’]
ঘ. চোখ তার সাদা কুয়াশার বক। [‘মেদিনীর পথে’]
ঙ. চোখ তার বিষলক্ষের ছুরি। [‘অপরাজিতা’]
চ. বিমুগ্ধ চোখ তার সরিষা ফুলের মতো/ সবুজ-হলুদ [‘স্কেচ’]
নারীর চুল নিয়েও কবিদের মুগ্ধতার শেষ নেই। রহস্যময়তা কিংবা উপমা প্রয়োগে নানাবিধ অর্থদ্যোতনাও কম পরিলক্ষিত হয় না। স্মরণ করুন, জীবনানন্দ দাশের ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ কবিতা-চরণ এবং মাওলা প্রিন্সের কবিতায় ‘চুল’ প্রসঙ্গ :
ক. চুলে তার শত বছরের কামিনীর ঘ্রাণ। [‘রেলিং’]
খ. চুল তার কঙ্কাবতীর মতো। [‘একটি চুল’]
গ. হেমাঙ্গিনীর মতো করে বেঁধেছিলো চুল [‘অপেক্ষার আঁধার’]
সে-সাথে মাওলা প্রিন্সের কবিতায় প্রকৃতি, নক্ষত্র, চাঁদ, পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, শিশির, পাখি, প্রজাপতি, কার্তিক, পৌষ, হেমন্ত প্রভৃতি স্থান পায় নিপুণ অনুভবে—, দক্ষ প্রয়োগশৈলীতে। যেমন :
কুড়ি কুড়ি বছর পর পুনরায় দেখা
বনশ্রীর পথে;
নাম তার মনে নাই
নক্ষত্রের মতো ক্ষয়ে গেছে
রাতের ভেতর;
কার্তিকের হিমে পার্বতীর চোখ ওমের পাহাড়— [‘নক্ষত্রের মতো’]
কিংবা,
পৌষের গাঢ় কুয়াশার ওমে প্রজাপতির মতো
চোখ নেড়ে বলেছিলো সে
এতো রাতে;
কুড়ি বছর পর আবার
রেলিংটা দেখে আসি রাতের ভেতর; [‘রেলিং’]
গ্রন্থভুক্ত প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই উপমা-রূপকের চিত্রকল্প আছে। দু’চারটি একেবারে নতুন, পাঠককে চমকে দেয়ার মতো। একটা নমুনা, ‘স্তন তার সবুজ নারিকেলের পাতা।’ [‘আগুন জ্বলে’] আরেকটা নমুনা হতে পারে, ‘মাদুলি হাতে বিলাসী মিশে শিসে-বিষে—’ [‘সোনার মুদ্রা’] মাওলা প্রিন্সের কবিতায় শারীরিক রূপ-সৌন্দর্য আছে, নেই কামজ লালসা। ‘চুম্বন’ কবিতায় দেখি :
কথা ছিলো প্রতিদিন একটি চুম্বন পাবার।
নীল আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির ধারা গায়ে মেখে
একদিন হেঁটেছিলাম পুরো প্যারিস রোড—
সিনেট ভবনে দাঁড়িয়ে থাকা
বুভুক্ষু চোখগুলো আমাদের তাড়া করেছিলো
আমরা হাঁটছিলাম আমরা ভিজছিলাম কী এক ঘোরের ভেতর;
কুড়ি বছর পর আবার আমরা হাঁটি আমরা ভিজি
যে যার মতন;
আমাদের সন্তানেরা পরিশোধ করে প্রতিটি চুম্বন— [‘চুম্বন’]
প্রতিটি কবিতা অতি ছোট। একই মাপ— নয় চরণ। কিন্তু, ভাব-বিষয় অনেক বড়— গভীর জীবনদর্শনসম্পৃক্ত। কবি মাওলা প্রিন্স এখানে অতীতস্মৃতিবিধুর। মানুষ, মনুষত্ব, প্রেমপ্রীতি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, প্রকৃতি, জীবনের পুনরাবৃত্তি আবার বছর কুড়ি পর কাব্যকে করেছে সমৃদ্ধ এবং নবমাত্রিকতায় ভাস্বর।
Discussion about this post