শেখ কামাল উদ্দীন
‘অনুধ্যান’ এই বিশেষ্য পদের একাধিক অর্থ হয়— ‘অনুচিন্তন, ‘সর্বক্ষণ চিন্তা, ‘ইষ্টচিন্তা, ‘স্মরণ ইত্যাদি। তাই গ্রন্থের নাম যখন “অনুধ্যানে নজরুল” হয় বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে প্রাবন্ধিক নজরুলকে কী চোখে, কীভাবে দেখেন। কখনো তিনি নজরুলকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্মরণ করেন, কখনো নজরুলই তাঁর চিন্তণের সর্বক্ষণের বিষয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ত্রিশাল, ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মাওলা প্রিন্স তাঁর পঞ্চম গ্রন্থ “অনুধ্যানে নজরুল” নজরুল গুণগ্রাহীদের উপহার দিয়ে নজরুল-পাঠে আগ্রহান্বিত করে তুলেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম— এই নাম উচ্চারিত হলে শ্রোতাদের কাছে প্রতিবাদী, নির্ভীক, বিদ্রোহী কবির একটি চির-পরিচিত রূপ ফুটে ওঠে; যিনি শুধু কবিতা নয়, শ্যামাসংগীত ও ইসলামী গজল রচনাতেও পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু, তার বাইরেও যে সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর স্বচ্ছন্দ অবস্থান ছিল, তা অনেক সময় সচেতন পাঠকেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। অধ্যাপক প্রিন্স কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য ও সংগীতের বাইরে গিয়ে তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস, অভিভাষণ, চিঠিপত্র নিয়েও আলাদা আলাদা পরিচ্ছেদে সুচিন্তিত আলোচনা করে গ্রন্থটির মর্যাদা বাড়িয়ে তুলেছেন।
দু’শো আট পৃষ্ঠার “অনুধ্যানে নজরুল” গ্রন্থটির পরিশিষ্ট অংশটি একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এখানে লেখক কবির বিভিন্ন গ্রন্থের প্রকাশকালসহ সারসংক্ষেপ দিয়েছেন, যা একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ; কেননা এই ধরনের গবেষণামূলক গ্রন্থে গ্রন্থনাম, প্রকাশক, প্রকাশস্থল, প্রকাশর সময় দেওয়া থাকে, কিন্তু সারসংক্ষেপ থাকে না। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই সারসংক্ষেপ অংশটি পড়লেই পাঠক বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে অনেকাংশেই বুঝে নিতে পারবেন। এজন্যে অধ্যাপক মাওলা প্রিন্সকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়।
প্রতিটি অধ্যায় শেষে মূল্যবান তথ্যনির্দেশ কবির গ্রন্থগুলি সম্পর্কে অনেক জিজ্ঞাসার অবসানের সহায়ক হয়ে উঠেছে। লেখক যে প্রচুর পড়াশোনা করে গ্রন্থটি রচনা করেছেন, তারও প্রমাণ মেলে এই তথ্যনির্দেশে। নজরুল নিয়ে অনেকের অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যার সঠিক মূল্যায়ন এখনও হয়নি। তবে লক্ষণীয় যে, নজরুল গবেষণার ব্যাপকতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্রন্থটি ভবিষ্যৎ গবেষকদের কাছে একটি মূল্যবান সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
মঞ্জুর এলাহীর প্রচ্ছদ সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাধ্যের মধ্যে গ্রন্থটির বিক্রয়মূল্য থাকায় খুব সহজেই পাঠক গ্রন্থটি কিনতে পারবেন, এদিক দিয়ে প্রকাশকদেরও সাধুবাদ জানাতে হয়। আর একটি কথা না বললেই নয়, আজকাল যাঁরাই কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে গ্রন্থ লেখেন তাঁরা সকলেই তাঁর জীবনকথা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে গ্রন্থটির কলেবর বৃদ্ধি করেন বটে; কিন্তু, সেখানে নতুন করে বলার কিছু থাকে না। অধ্যাপক প্রিন্স সেদিকে না গিয়ে সরাসরি তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য অবশ্যই তিনি ধন্যবাদ প্রাপ্তির যোগ্য।
তবে, এই গ্রন্থে কাজী নজরুল ইসলামের সব ধরনের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করা হলেও তাঁর আর একটি মূল্যবান সাহিত্যসৃষ্টি নাটক নিয়ে কেন আলোচনা হলো না, সে ব্যাপারে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। এছাড়া উদ্ধৃতিগুলি যা ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলি আর একটু বৃহত্তর ফন্টে দেওয়া হলে বোধহয় ভালো হতো। পাঠকের পড়তে সুবিধা হতো। সব মিলিয়ে এই গ্রন্থটি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে পাঠকের কৌতূহল বাড়িয়ে তুলবে বলাই বাহুল্য।
Discussion about this post