মজিবুর রহমান
আধুনিক কালের সাহিত্যে অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধতম ও জনপ্রিয় শাখা ‘উপন্যাস’। জীবনের এক সুসংবদ্ধ শিল্পিত রূপ এটি। ‘উপন্যাস’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘কল্পিত কাহিনি’। কিন্তু, আধুনিক পরিভাষায় উপন্যাস শব্দটি অনেকগুলো বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বিশ্বজগতের সীমাহীন বিচিত্র জীবনলীলা, মানবজীবনের বহুমুখী গতিপ্রকৃতির যথাসম্ভব সমগ্র ও শিল্প-সমন্বিত রূপ দেওয়াই মোটের উপর উপন্যাসের লক্ষ্য। এ কারণে আধুনিক সাহিত্যে উপন্যাসের অর্থ হচ্ছে উপস্থাপন। অর্থাৎ, বিশেষ রীতি ও নিয়মের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিকাঠামোর যে কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে তাই উপন্যাস। মূলত, ‘জীবনের সামগ্রিকতাকে শিল্পিত ফ্রেমে আঁটবার আধুনিক প্রয়াস উপন্যাস। কবিতা, নাটক কিংবা ছোটগল্পের চেয়ে উপন্যাসশিল্পে একজন শিল্পী তাই অনেক বেশি জীবনমুখী।’ (মাওলা প্রিন্স, ২০১৯ : ৯৯) ‘ছোটগল্পের পরিসর যেখানে সংক্ষিপ্ত, নাটক যেখানে মঞ্চ প্রযোজনা ও অভিনয় দক্ষতার ওপর অনেকাংশ নির্ভরশীল, উপন্যাসে সেখানে রয়েছে বিস্তৃত ন্যারেটিভ পরিসর; কোন বহির্মুখী উপকরণের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার প্রয়োজনও ঔপন্যাসিকের নেই; তাঁর শিল্পের সংসারে তাঁর একচ্ছত্র স্বরাজ।’ (কুন্তল চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৯ : ১৪০) জীবনের বহুমাত্রিক রূপ-কল্পনাকে শিল্পীর তুলিতে তুলে ধরতে ঔপন্যাসিককে একাগ্রচিত্তে অনুসন্ধান করতে হয় মানব জীবনের স্বরূপ, মানব চারিত্র্যের রহস্য ও মানবের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া ‘জীবনকে এক ভাবে এক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে তার বহিঃ ও অন্তর্বাস্তবতা ব্যবচ্ছেদ করে উল্টে-পাল্টে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করাই শিল্পীর কাজ। একজন ঔপন্যাসিক খুন হওয়া কোনো ব্যক্তির জন্য যেমন অশ্রুসিক্ত হন, তেমনি সহানুভূতিশীল হন উক্ত খুনির প্রতিও। এটা স্ববিরোধ নয়, মানুষের প্রতি শিল্পীর মমত্ববোধ। এজন্য তাকে অনুশীলন করতে হয়। তাকে উপযুক্ত ভাষা, সংলাপ, বর্ণনা কিংবা আবহ তথা পারিপার্শিকতা তৈরি কিংবা সৃষ্টি করে প্রত্যেকটি চরিত্রকে জীবন্ত করতে হয়। কার্যকারণসূত্রে আবদ্ধ ঘটনাবলীকে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। এজন্য তাকে আশ্রয় কিংবা অভিজ্ঞতা নিতে হয় ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুরাণ-কুরআন, বিজ্ঞান-দর্শন কিংবা সমসাময়িক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে।’ (মাওলা প্রিন্স, ২০১৯ : ১০০) এরূপ জীবনঘনিষ্ঠ ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের শিল্পভাষ্য ‘উপন্যাস’ গত দেড় শতকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা হয়ে উঠেছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এর শিল্পোত্তীর্ণ সৃষ্টি দিয়ে এই যাত্রা শুরু হলেও বর্তমান কালেও রয়েছে উপন্যাসশিল্প রচনার সরব প্রচেষ্টা। ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্করদের যুগ আর নেই। এঁদের অভিজ্ঞতায় ভর করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিংবা শহিদুল জহিররা নতুন নতুন পথ সৃষ্টি করেছেন। এই অভিজ্ঞতায় দাঁড়িয়ে বর্তমান সময়ের ঔপন্যাসিকরা নিজ নিজ পথ নির্মাণ করার চেষ্টা করছেন, কেউ কেউ পারছেন, কেউ কেউ পারছেন না। তবে এই কথা এখানে স্বীকার করা যায় যে, ২০২২ সালে প্রকাশিত মাওলা প্রিন্সের প্রথম উপন্যাস বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি-তে নতুন পথ নির্মাণের প্রচেষ্টা প্রবল মাত্রায় ধরা পড়েছে।’ (মেহেদী ধ্রুব ২০২২)
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি (২০২২) উপন্যাসটি একটি মহাকাব্যিক ক্যানভাসে রচিত হলেও খুব সহজেই চোখে পড়ে উপন্যাসের বিষয়, আঙ্গিক ও শৈলী বিচারে ঔপন্যাসিকের স্বাতন্ত্র্য। দীর্ঘ অবয়বের এই উপন্যাসটিতে নেই কোনো অধ্যায় কিংবা পরিচ্ছেদ বিভাজন। এতে রয়েছে বৌদ্ধিক পাঠককে আকর্ষণ করার মতো ঔপন্যাসিকের বহুমাত্রিক জীবনবীক্ষা। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়কে নিরীক্ষাপ্রবণতায় চেতনাপ্রবাহের আশ্রয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাণবন্ত ও গতিশীল করেছেন উপন্যাসের আখ্যানে। তাঁর বহুমাত্রিক জীবনবীক্ষায় খুব সহজে ধরা পড়েছে বৌদ্ধিক ও সামগ্রিক চেতনায় ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, ভূগোল, ভাষা, ভূমি, প্রেম-প্রণয়, যৌনতা, স্বপ্ন, ধাঁধা, রাশিফল, প্রকৃতি, সভ্যতা, শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, চিকিৎসা, দুর্যোগ-মহামারি-দুর্নীতি, নাটক-সিনেমা-সাহিত্য, মিডিয়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মতো জীবনঘনিষ্ঠ রূঢ়বাস্তবতা। আমাদের সকলের পরিচিত জীবন ও জগৎ নিয়ে অকপটেই বলে গেছেন তিনি জীবনের এই নির্মম সত্য কথাগুলো। জীবনের কঠিনতম সময়ের সাক্ষী হয়ে তথা মৃত্যুকে চাক্ষুস উপলব্ধি করে তিনি নির্মাণ করেছেন এই উপন্যাসের রূপাবয়ব। মানবসভ্যতা যখন অদৃশ্য এক শক্তির সাথে যুদ্ধরত বেঁচে থাকার তীব্র বাসনা নিয়ে; মৃত্যু যখন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে মানুষকে তখন, কিংবা জীবন আটকে গেছে একটি কক্ষ বা চার দেওয়ালে; ঠিক সেসময়টাকে আঁকড়ে ধরে মাওলা প্রিন্স দেখেয়িছেন মানুষের জীবনের আসল সত্য রূপটি। একুশ শতকের সূচনালগ্নে মানবসমাজ যে ভয়াবহ নির্মমতার সাক্ষী হয়েছে, তা থেকে উপলব্ধ জ্ঞান কিংবা সঞ্চয়িত অভিজ্ঞতা মাওলা প্রিন্সকে উপন্যাসটি রচনার প্রেরণা সঞ্চারিত করেছে। তাইতো তিনি উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন :
কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসে পৃথিবীতে প্রাণ হারানো নথিভুক্ত ও নথিহীন সকল স্বর্গীয় আত্মার প্রতি এবং সেইসব মানুষের প্রতি, যারা করোনা প্রতিরোধে ও জীবন বাঁচাতে নিজেকে নিবিষ্ট রেখেছেন। (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ৫)
মহামারী করোনার প্রবল ভয়াভহতায় আচ্ছন্ন হয়ে তিনি মৃত্যু চেতনায় নিমজ্জিত। মৃত্যুর মতো নির্মম সত্য দিয়েই সূচনা করেছেন উপন্যাসের। কেবল মৃত্যুই মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগায় আর বেঁচে থাকতে হলে তাকে যুদ্ধ করতে হয় প্রতিনিয়ত, নিজের সাথে কিংবা দৃশ্য-অদৃশ্য নানান শক্তির সাথে। তাই এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকাই একটা যুদ্ধ আর দিনশেষে বেঁচে থাকতে পারাই তো শান্তি। জন্মের সূচনালগ্ন থেকে মানুষ যুদ্ধ করে; যুদ্ধ করেই প্রতিকূল পরিবেশে সে টিকে থাকে এবং একদিন হয়তো সফলতা বয়ে আনে। মাওলা প্রিন্সের এ উপন্যাসেও আমরা তেমনি এক নাম না জানা কথকের জীবনযুদ্ধ কিংবা তাঁর জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু জীবনের যুদ্ধকে উপলব্ধি করতে পারি। গতানুগতিক আখ্যান বিন্যাস কিংবা গল্প বলার রীতি থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে উত্তমপুরুষের জবানীতে তিনি বলে গেছেন তাঁর কিংবা তাঁর পরিবার ও প্রতিবেশের আরও কিছু মানুষের জীবনের নির্মম রূপটি। তাদের উত্থান-পতন, বেড়ে ওঠা, হয়ে ওঠা, বাধাপ্রাপ্ত হওয়া এবং বয়ে চলার মধ্যেই রয়েছে জীবন ও জগতের শাশ্বত রূপ। বলতে গিয়ে কোথাও দ্বিধান্বিত হন নি তিনি। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস, জ্ঞান, দর্শন, স্বপ্ন, ভ্রম, সংস্কার, চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা জাত উচ্চতম কল্পনাশক্তির সারবত্তা হয়ে উঠেছে এটি ।
কোভিড-১৯-এর মৃত্যুর মিছিলকে অবলম্বন করে এই উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়। মৃত্যুভাবনায় কাতর কথকের মনে হতে থাকে আমরা সবাই একদিন মারা যাবো। আর মাত্র পনের কী ত্রিশ কী পঁয়তাল্লিশ দিনের মধ্যেই মারা যাবো। সময়টাকে তিনি ধারণ করেছেন এভাবে :
দিন পেরুলে দুই-তিন-চার হাজার করে জ্যান্ত মানুষ শামিল হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসহায় এক মৃত্যুর মহামিছিলে। সময়টা অদ্ভুত। এমনটা কেউ কখনো দেখে নি। পৃথিবীর সব দেশ সব মানুষ এক নিয়মে ঘরবন্দি, এক ভাবনায় আচ্ছন্ন, এক শঙ্কায় শঙ্কিত, এক আতঙ্কে আতঙ্কিত, এক গবেষণায় নির্ঘুম। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার উদাত্ত উন্মুখ দ্বারগুলো আশ্চর্যজনকভাবে জনশূন্য এবং লোকসমাগম ঠেকাতে রুদ্ধ ও সঙ্কুচিত। (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ৮)
মৃত্যুচেতনা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, প্রতিদিনকার মতো করোনার আপডেট তথ্য শুনে সুনসান বিছানায় শুয়ে পড়লেই কথক চেতনার অবিমিশ্রতায় ভেসে উঠে তার পারিবারিক কবরস্থান। শুরু হয় সময়ের ঘূর্ণিপাক, আখ্যানে আসে নব নব ভাব-কল্পনা, অতীত-বর্তমানের মেশামেশিতে কথক নস্টালজিয়ায় ভর করে পাঠককে নিয়ে যায় জীবনের নগ্নতম রূপে; উন্মোচন করে তার অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনসত্যগুলোকে। এ সত্য থেকে বাদ যায় নি মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি, নিজ সন্তান, পরিবেশ-প্রতিবেশ, রাষ্ট্র-সরকার, এমনকি কথক নিজেও। অধ্যাপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশও ঘটে এতে।
দিদি, দাদি বা দাদিমার কোলে মাথা রেখে মুক্তিযদ্ধের গল্প শোনা, মিলিটারি কর্তৃক বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, দিদিমার বৃদ্ধ পিতাকে না মারা, দাদির সন্তানদের আগলে রাখা, সেই মহান যুদ্ধে বাবা-চাচার অংশগ্রহণ না করা কিংবা কথক নিজে যুদ্ধ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেও যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা কে মূল্যায়ন না করার নগ্ন রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। সার্টিফিকেট তথা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা ও জালিয়াতির মতো সত্যকে প্রকাশের প্রচেষ্টা রয়েছে কথকের। ঔপন্যাসিকের ভাষ্য :
দাদু আপনি নাকি যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু, আপনার নাকি সার্টিফিকেট নেই? […] সার্টিফিকেটের জন্য তো যুদ্ধ করি নাই, বয়স কম ছিলো, যৌবন আছলো, দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধে গেছি, ভাবছিলাম সার্টিফিকেট দিয়া কী হইবে, এ্যালা যে সেই সার্টিফিকেটের কতো দাম তখন তা বুঝবার পারি নাই, ঐ সার্টিফিকেটটা থাকলে আইজ আমার…! (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ২৫৮-২৫৯)
তাছাড়াও উপন্যাসে তিনি কতিপয় আপাত সুবিধাভোগী মুক্তিযোদ্ধা কিংবা স্বাধীনতার-পরবর্তী সময়ে তাদের বিপথগামী বর্বতার চিত্র তুলে ধরেছেন :
থামেন, থামেন, মুক্তিযোদ্ধা, কতো মুক্তিযোদ্ধা আছে বৌকে বইন সাজায়া নিজের নামে জমি কবলা করতে দ্বিধা করে না, কতো মুক্তিযোদ্ধা কতো সংখ্যালঘুর ঘর-বাড়ি জায়াগা-জমি গ্রাস করলো, প্রিন্সিপালের মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে বিয়ে করার ঘটনাও আছে, জাফরুল্লাহ চৌধুরীও তো বঙ্গবন্ধুকে পটিয়ে হাসপাতালের নাম করে সাভারে অনেক জমি নিছে। (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ১৫৫)
মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঔপন্যাসিকের এই জ্ঞানগর্ভ চিন্তা-চেতনা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত বিচারে অনেকাংশে সত্যতা পাওয়া যায়। বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো একটি দৃশ্যমান অপশক্তির সাথে, কিন্তু আজ তারা যুদ্ধরত একটা অদৃশ্য শক্তির সাথে। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল লাখ লাখ মানুষও অংশগ্রহণ করে এতে। গৃহবন্দি এই সকল মানুষের এখন একটাই যুদ্ধ, তা হচ্ছে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। বিষাদে, উত্তেজনায়, আতঙ্কে আর সিদ্ধান্তহীনতায় গার্মেন্টস ও কারখানার মালিকরা একবার প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখার কথা বলে, আবার সীমিত পরিসরে খোলা কিংবা শ্রমিক ছাঁটাই করার কথা বলে। এতে করে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মনে আতঙ্ক বেড়ে যায়। দিশেহারা শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে শত শত কিলোমিটার পাড়ি জমায় : ‘তবুও দল বেঁধে শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে শত, অর্ধশত কিংবা শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিচ্ছে কাজের আশায়, পাওনা বেতনের দাবিতে, বেঁচে থাকার যুদ্ধে, জীবনের সন্ধানে।’ (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ১৭) তাদের এই দুর্বিষহ-অনিশ্চিত জীবনের গতি-প্রকৃতি দেখে একশ্রেণির মানুষ বিরক্ত হয়; যারা ঘরে বসে মিডিয়ায় চোখ রাখে তারা আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় বলে, এভাবে চলতে থাকলে করোনা আরও বেশি ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু, ক্ষুধাতুর মানুষ ঘরে থাকতে পারে না। সরকারি কিংবা ব্যক্তিগত অনুদান কিংবা আর্থিক সহায়তা বা ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ হলে কিছু মধ্যস্থতা অথবা সুবিধাভোগী মানুষের জন্য তা সুষ্ঠু বণ্টন হয় নি, শ্রমজীবী মানুষদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছায় নি। তাই তারা বলে :
বাপধন কিংবা বাবাজি, একটা মাস বাড়ির বাইর হই না, বাড়িতে কুনু বা কোনো কিংবা এক ছটাক খাবার নাই, বাধ্য হয়ে বা হইয়্যা আজ বা আইজ বা আইজক্যা বাইর হইছি। হ, হ, পাইছি পাঁচ কেজি চাইল, দুই কেজি আলু, এ্যাক কেজি ডাইল, আধা সের লবণ, দুই লিটার ত্যাল আর একটা হাত বা আত ধোয়ার সাবান বা সাবোন; কিন্তু, তা বা তয় দিয়্যা কয়দিন চলে? (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ১৭)
এদিকে মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে তাদের করুণ পরিণতি। রাস্তায় কড়া নিরাপত্তায় থাকে পুলিশ, সেনাবাহিনী; কখনো কখনো র্যাব কঠোর থেকে কঠোরতর হয়। শ্রমজীবী মানুষেরা মাছের ড্রামে কিংবা সবজির ট্রাকে করে গাজীপুর কিংবা নারায়ণগঞ্জ যেতে থাকে। মিডিয়া এই নিদারুণ চিত্র ফাঁস করে করে দিলে তিনি দেখিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষের বেদনা বিধুর আর্তচিৎকার :
গরিবের শান্তি নাই, গরিব মানুষ জীবন বাঁচার জইন্য মাছের ড্রামে করি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর গেইলে করোনা ছড়ায়, আর, বড়লোকেরা প্রাইভেট গাড়িতে চইড়ে ঈদ কইরতে দ্যাশের বাড়ি গেলি করোনা পালায়, উল্টা পথে দৌড়ায়, লৌড়ায়! (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ১৭)
এরকমই নির্মম সত্যকে তিনি প্রকাশ দিয়েছেন তাঁর উপন্যাসে। ‘করোনাকালীন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় দৈশিক ও বিশ্বরাজনীতির জটিল-কুটিল নগ্নরূপ ধরা পড়েছে ঔপন্যাসিকের বয়ানে। একমেরু বিশ্বব্যবস্থা কায়েমের বাসনায় দাতাদের রূঢ়তা, ভূ-রাজনীতি, স্নায়ুযুদ্ধ, জীবন-জীবিকায় একজনকে ঠকিয়ে অন্যজনের উপরে ওঠার তীব্র অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় নিরন্তর ছুটে চলার রথকে হঠাৎ থামিয়ে কোভিড-১৯ যদিও জীবন-যাপনে কিছুটা স্থিরতা ও বিশ্রাম দিয়েছে, প্রকৃতি নিজের অপরূপতা খুঁজে পাবার একটা অবকাশ পেলেও রূপকথার গল্পের মতো পুরোটা দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন বাস্তবে সম্ভব নয়।’ (ফাহিদা সুলতানা, ২০২২) করোনা নিয়ে সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কৃতকার্য-অকৃতকার্য, কারচুপি, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা, অর্থ আত্মসাৎ কিংবা ভ্যাকসিন আমদানী ও বহির্বিশ্বের নানান দৃশ্য তিনি তথ্য-উপাত্তসহ চিত্রিত করেছেন দক্ষ শিল্পীর ন্যায়। করোনাকালীন বাস্তবতায় তিনি মহামারী করোনার ভয়াবহতা রূপায়ণ করেছেন অত্যন্ত নিঁখুতভাবে। একইসাথে তিনি আশার বাণীও শুনিয়েছেন পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে। কলেরার মতো অতিমারী, মহামারিও একদিন মানুষ জয় করেছেন তাদের বৈজ্ঞানিক দক্ষতা দিয়ে। এরূপভাবে হয়তো করোনাকে মানুষ জয় করে থাকবে এবং বাস্তবিক তাই হয়েছে, আজ আমরা করোনাকে জয় করে নিয়েছি। তাঁর ভাষ্যমতে :
সহজ কোনো পন্থা আবিষ্কারের মধ্যেই পতন ঘটবে মহারাজ ও মহাতঙ্ক কোভিড করোনার; চিন্তা করে দেখো, একদিন কতো লোকই না কলেরা মহামারীতে মারা গেছে, গেছেন; […] ১৮১৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের মহামারীতে পৃথীবিতে কতো কোটি কোটি মানুষ যে শুধু কলেরায় মারা গেছে, তার হিসাব নেই; অথচ, মৃত্যুঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আজ কলেরা যেনো কোনো বিষয়ই নয়; (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ১১০-১১১)
এখানেও ঔপন্যাসিক তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ছেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে, কিংবা তিন সন্তানের বাবা হিসেবে, কখনোবা প্রেয়সী-প্রিয় স্বামী হিসেবে, অথবা কখনো স্নেহাশীষ পুত্র, কারো ভাই, কারো বন্ধু, কারো জামাতা, কারো ছাত্র, কারো প্রতিবেশী হিসেবে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রেখে গেছেন নিজের আদর্শের জায়গা থেকে। সবগুলো জীবনকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন তার মতো করে। তাইতো আজ গৃহবন্দি হয়ে কথক স্মৃতি হাতরায় শেকড়ের। ঘুরে ফিরে পাঠককে নিয়ে যায় তার জন্মস্থানে। মানুষ মাত্রই তার শেকড়ের প্রতি দুর্বল ও আবেগপ্রবণ। কথকের মধ্যেও সেই দিকটার প্রকাশ পাওয়া যায়। নিজের বেড়ে ওঠার, হয়ে ওঠার গল্প যেমন তিনি বলে গেছেন স্বচ্ছভাবে, সততার সাথে, তেমনি মা-স্ত্রী-দাদি-নানি পূর্বসূরিদের গল্পও পাঠকদের শুনিয়েছেন অতি সযতনে। কোনোরূপ সেচ্ছাচারিতা ছাড়াই অকপটে বলে গেছেন জীবনের নানান অভিজ্ঞতা। লেখকের শিশুকাল, বাল্যকালে পায়ে পায়ে জড়ানো দরিদ্রতা, মধ্যবিত্তের জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের লড়াই; দাদা-দিদি বা দাদি-নানা-নানি-বাবা-চাচা-মামা কেউ বাদ যায় নি সে লড়াই থেকে। সমবয়সী প্রেম-প্রণয়-পরিণতি কিংবা চাকুরিসূত্রে আপাত বিচ্ছিন্নতা; বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, প্রিয়তমা স্ত্রীকে শখের মনিপুরী শাড়ি কিনে দিতে না পারার দুঃখবোধ—, সবকিছুই যেন অনুপুঙ্খানুভাবে তিনি তুলে ধরেছেন। সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা দিয়েও তিনি জীবনের কঠিনতম সত্যকে চিত্রিত করেছেন। নানা-নানির সম্পর্কের টানাপোড়েনে সেই দিকটা প্রকাশ পায়। দাদার দ্বিতীয় বিয়ের সংবাদে জীবন সম্পর্কে গভীরতম অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার নানার শেষ জীবনের সহজ স্বীকারোক্তি :
বিয়াই আমি তোমার দুই পায়োত্ পড়ি, তোমার দুই পাও ধরি, তাও এই ভুল করেন না, আমি জীবনে যে ভুল কইরছি, এই ভুল আর আপনি করেন না, আমি যে দোজখের আগুনে জ্বলছি, আপনি সে আগুনে জ্বলেন না, আমি বয়সে বড় হয়্যাও আপনার পা ধইরছি, বিয়াই কতা দ্যান, দোসরা বিয়া কইরবেন না, বিয়াই, এই ভুল কইরবেন না, কথা দ্যান…! (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ১৩৪)
উপন্যাস পাঠে কথকের জন্মস্থান তথা বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের লালমনিরহাট জেলা ব্যাপক অর্থে উত্তরবঙ্গের মানুষদের জীবন ও জীবিকার দৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়। পাঠকের চোখে ধরা পড়ে তৎকালীন সময়ে সেই অঞ্চলের মানুষের দুর্বিষহ জীবন-যাপন। মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষের দুর্যোগপূর্ণ জীবন-যাপন। কৃষিনির্ভর বৃহত্তর রংপুরে মানুষ বিনা খাদ্য, অপুষ্টি, অশিক্ষা ইত্যাদির জন্য ছোটতো লঙ্গরখানায় কিংবা বিদেশি এনজিওগুলোর ধারে ধারে। কথক তার বাবা-চাচাদের মুখে শুনতে পেতো ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য বাজারে মানুষ নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দিতো। জীবন ধারণ করাটা তাদের জন্য বড়ো যুদ্ধ ছিলো, বেঁচে থাকাই ছিলো মুখ্য। কথকের ভাষ্যমতে :
এই মঙ্গায় মানুষ তার সন্তানদের পর্যন্ত বিক্রি করে দিতো; আব্বু কিংবা আঙ্কেলদের কাছে শুনতাম, আজ বা আইজ বাজারে বা বাজারত খুনিয়াগাছ কিংবা কালমাটি কিংবা ত্যামনি কিংবা গোকুন্ডের একটা মানুষ তার ছাওয়াটাক কিংবা ছাওয়াদুটাক বেচে বা বেচ্যায়া দিছে, দিলো! মঙ্গা আর বন্যার সময়ে চারিদিকে শুধু হায় হায় আর্তনাদ শোনা যেতো, বেঁচে থাকার জন্য মানুষ তার ঘরের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও থালা-বাটির সঙ্গে তাদের সন্তানদেরও বিক্রি করে দিতো, শহরের কোনো নিঃসন্তান মানুষ বাচ্চা কিনে নিয়ে যেতো, হয়তো কেউ কেউ সারা বছরের জন্য কাজের ছেলে বা মেয়ে হিসেবেও বাচ্চাগুলোকে নিতো! (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ২৩)
দুর্যোগ-দুর্ভিক্ষ-মহামারী-অতিমারীর পাশাপাশি রয়েছে ঔপন্যাসিকের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। তার দুঃখবোধ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে, সম্ভাবনাময় উর্বব ক্ষেত্র আছে, কিন্তু দারিদ্র্যমুক্ত বর্তমান নেই। তাই তিনি বলেন :
দুঃখ, আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে, সম্ভাবনাময়ী উর্বর ক্ষেত্র আছে, কিন্তু, দারিদ্র্যমুক্ত বর্তমান নেই! সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, সবকিছুতেই রাজনীতিকরণ আর বিভেদ সৃষ্টির মানসিকতা এবং জাতীয় ভিশন, মিশন, ইউনিটি ও কন্সিস্টেন্সি তৈরিতে নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতার কারণে আমাদের সীমাহীন দুর্ভোগ ও দুর্গতি! আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আছে, অথচ সুসম সচ্ছলতা নেই; আমাদের বিবিধ প্রকল্প ও প্রতিষ্ঠান আছে, অথচ কোথাও শতভাগ স্বচ্ছতার প্রচেষ্টা নেই; আমাদের বৌদ্ধিক জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে, অথচ যথোচিত মূল্যায়ন নেই; একটি উন্নত দেশ গড়বার লক্ষ্যে আমাদের কী নেই, সবই আছে, শুধু সমন্বিত ব্যগ্রতা নেই! (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ২৫৪)
আর্থরাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় উত্তরবঙ্গ নিয়ে কথকের তথ্য-সমৃদ্ধ জবানীতে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটলেও ব্যাপক অর্থে কোনো পরিবর্তন আসে নি বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে। অর্থনৈতিক সমীক্ষার রিপোর্ট জরিপ করেও তিনি গত কয়েক দশকের চিত্র তুলে ধরেছেন। এছাড়াও সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান বা রাষ্ট্র পরিচালনার মসনদে বসে থাকা ব্যক্তিবর্গের সাথে উত্তরবঙ্গের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সেখানে আসে নি কোনো যুগান্তকারী পরিবর্তন। কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা দিতে গিয়ে কিংবা সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ তিনি বলেছেন :
এবার আসা যাক সরকারি পরিকল্পনা ও উদ্যোগে আঞ্চলিক বঞ্চনা কিংবা বৈষম্য প্রসঙ্গে; […] তাহলে, কী দাঁড়ালো, নিশ্চয়ই সরকার এই অঞ্চলের জন্য বিমেষ পরিকল্পনা নেয় নি, কিংবা, কোনো কার্যকরী উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে, কিংবা, বঞ্চনা করেছে রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলকে, পুরো উত্তরবঙ্গকে! (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ৭৯)
শাসকবর্গের সরাসরি মন্তব্য করতেও দ্বিধান্বিত হন নি তিনি। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকেই তাঁর স্পষ্ট ভাষ্য :
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ছিলো, ছিলেন, একাধারে সেনাপ্রধান ও একনায়ক শাসক; […] তিনি হয়তো দেশের মানচিত্রে রংপুর অঞ্চল কিংবা উত্তরবঙ্গকে পৃথক করে দ্যাখেন নি, ভাবেন নি, ভাবতে চান নি, […] শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তো বগুড়ার সন্তান; সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্ম ও জন্মোত্তর শৈশব-কৈশোর কেটেছে দিনাজপুরে, দিনাজপুরে থাকাকালেই সেনাকর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিলো, শুনেছি, সেখান থেকে চলে গেছেন করাচিতে, ঊনসত্তরের মার্চ-এপ্রিলে ফিরেন ঢাকায়, ফেনী তার আদি পিতৃভিটা; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের পুত্রবধূ, তার স্বামী পরমানুবিজ্ঞানী ডক্টর এম এ ওয়াজেদ মিয়া রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার সন্তান; অথচ, শিক্ষা, অর্থনীতিতে উত্তরবঙ্গের কী দৈন্যদশা, উত্তরবঙ্গ প্রসঙ্গে শাসকদের কী অনীহা; অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট আর কী; (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ৮০)
একই সাথে রয়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও নানান মতাদর্শ। শিক্ষাবান্ধব শিক্ষক কিংবা একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন নতুবা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন শিক্ষাব্যবস্থার গলদ। সৃজনশীলতার নামে কেবল ধ্বনিময় পরিবর্তন হয়েছে, গুণগত কোনো পরিবর্তন আসে নি শিক্ষাব্যবস্থায়। তাই তিনি সহজেই বলেছেন :
আমি শিক্ষার্থী-বান্ধব শিক্ষক নই, আমি শিক্ষাবান্ধব শিক্ষক। শিক্ষা ও আইনবান্ধব একজন শিক্ষক। যারা জানো না তারা জেনে নেও। জেনে রাখো। যে বা যারা শিক্ষার্থীদের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা-আতা-সোনা-ময়না সম্বোধন করে দশে আট-নয়-দশ দেয়, আদরে-সোহাগে পুরোটাই ঢেলে দিতে চায়, সবাইকে এ প্লাস, জিপিএ ফাইভ, আর, আউট অব ফোরে সিজিপিএ ফোর দিতে উন্মুখ, বস্তুত তারা শিক্ষার্থীর ক্ষতি করে। (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ২৭৯)
আবার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও রয়েছে উদাসীনতা বা ফাঁকিবাজির প্রবণতা। সেখানেও তিনি গঠনমূলক কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন :
তুমি একাডেমিক পড়া করবে না, তুমি চাকুরির পড়া পড়বে না, তুমি স্কলারশিপের চেষ্টা করবে না, বিদেশ যেতে ইচ্ছা পোষণ করবে না, বিশেষ কোনো কাজ-কর্মে দক্ষতা অর্জন করবে না, তোমাকে না পড়িয়ে আমার দাস বানিয়ে রাখলেই তুমি খুশি হতে। ছাগল-গাধার জীবনই তোমার আরাধ্য! (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ২৮০)
আবার উপন্যাসের শেষপর্যায়ে এসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাঠককে আটকে রাখে কিছু জীবনঘনিষ্ট ও বাস্তবসম্মত বিষয়কে উপস্থাপন করেন। নিজেকে আসামী বানিয়ে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলতে থাকেন, চাকুরী প্রত্যাশী হাজারো বেকার শিক্ষার্থীর, সময়ের সবচেয় বড় ও জাতীয় ইস্যু কোটা সংস্কারের প্রসঙ্গটি :
আপনি কোমলমতি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে কোটাবিরোধী আন্দোলনে উসকে দিয়েছিলেন, ‘প্রথম শ্রেণি চাকুরিতে কোটা কখনোই নয়’ জাতীয় একটি চটকদার প্রচারণা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ, দুঃখিত মাননীয় আদালত, কোটি কোটি চাকুরি প্রত্যাশী যুবক-যুবতীর চাকুরি পথ অবরুদ্ধ করেছেন…। (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ২৬৬)
ধর্ম-দর্শন-ইতিহাস-বিজ্ঞান-ভূগোল-নৃবিজ্ঞান-সাহিত্য-সংস্কৃতি-খেলাধুলা-রাশিফল ইত্যাদি নিয়েও তিনি জীবনের গভীরতম উপলব্ধি নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। কৃষকদের জীবনের দুঃখ-দুর্দশার চিত্রও দেখতে পাওয়া যায় এখানে। তিনি বৃদ্ধ আলু চাষীর সফলতা ও ব্যর্থতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় দুর্বলতা কিংবা অপরাগতার কথা বলেছেন। বিটিভিতে প্রচারিত ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের সফল আলু চাষীর করুণ পরিণতির নেপথ্যে সরকারি মদদ কিংবা জাতীয় উৎপাদন ও বাজারের যোগান ঠিক রাখার কূট-কৌশলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে :
আপনার সর্বস্বান্ত হওয়ার জন্য নাকি শাইখ সিরাজই দায়ী, টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে আপনাকে দেখালে আপনি নাকি ফুলেফেঁপে আটখানা হয়ে আরো বেশি মাত্রায় আলু চাষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সবুজ রঙের পাইলট শার্টপরা শাইখ সিরাজ নাকি পামপট্টি দিয়ে কৃষককে একরূপ সর্বস্বান্ত করে জাতীয় উৎপাদন ও বাজারের জোগান ঠিক রাখেন, আপনার কী ভাষ্য দাদু? (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ২৫৭)
দুর্নীতি জাতির উন্নতির অন্তরায়। সে দিক বিবেচনায় তিনি জাতীয় ক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়েও চমকপ্রদ মন্তব্য করেছেন। তার একটি সোস্যাল এনালাইসিসও তুলে ধরেছেন। সমাজে অল্প সংখ্যক দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের জন্য কিংবা তাদের সহযোগী ও সহচারী কতিপয় ব্যক্তিবর্গের জন্য সৎ ও আদর্শবান ভালো মানুষগুলো তলিয়ে থাকে। তাঁর ভাষ্য :
অসৎ দুর্নীতিগ্রস্ত মন্দরা সবসময়ই সঙ্ঘবদ্ধ, আর সৎ ও আদর্শবান ভালোরা সিন্ডিকেট না করে একা একা নিরিবিলি পথ চলতে ভালোবাসেন। এ বিষয়ে আমার একটা সোস্যাল এ্যানালাইসিস আছে, যেখানে ক্ষুদ্রতম বৃত্তে আপাদমস্তক দুর্নীতিপরায়ণ দুর্বৃত্তের পার্সেনটেজ সর্বোচ্চ ফাইভ; […] কোনো প্রতিষ্ঠানে বা সমাজে বা রাষ্ট্রে কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ফাইভ পার্সেন্ট দুর্নীতিপরায়ণ দুর্বৃত্তকে সবাই চেনে এবং সমীহ করে, কিন্তু, একই অনুপাতের অন্য ফাইভ পার্সেন্ট দুর্নীতিমুক্ত সৎ ও সজ্জনকে কেউ কেউ চিনলেও ওরা সম্মুখে স্থান পায় না, সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্ব কিংবা মিডিয়া ওদেরকে খুব একটা চেনে না, চেনার প্রয়োজনও বোধ করে না। (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ২৪৮-২৪৯)
পাশাপাশি ঔপন্যাসিক বিভিন্ন সময়ে নানান রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। কবরস্থান, কবুতর, কাক, ইঁদুর, বানর, শূকর ইত্যাদি রূপকের আশ্রয়ে সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গ কিংবা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ সার্থকভাবে ঘটিয়েছেন। গ্রামে দাদির কৃষি নির্ভর সংসারের বর্ণনা দিতে গিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অন্তঃসারতার ভাব প্রকাশ করেছেন। সরকারি বীজের অকার্যকারিতা আর দেশি বীজ ইঁদুরে খাওয়ার প্রসঙ্গে মূলত দাদির জবানীতে রাষ্ট্রীয় ও বহিরাগত অপশক্তির কূটকৌশলকে রূপকায়িত করেছেন। ঔপন্যাসিকের ভাষ্য :
বীজ সংরক্ষণ সম্পর্কে আরো শুনবে, যেইকনা আছলো, তাও ইন্দুর-ধরোয়া খায়্যা ফ্যালাইছে, দেশি ইন্দুর আর বিলাতি ইন্দুর মিলি সৌগ্ নষ্ট কইরছে; […] বীজের ভিতর্যাতেই দোষ আছলো, সরকার থাকি যে বীজগুলা দেছে, দিছে, ঐল্ল্যা ভাল্ নোয়্যায়, হুদাই দ্যায়, হুদাই আবাদ করি, আর, কান্দি মরি! (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ৭৯)
এছাড়াও উপন্যাসে রয়েছে শান্তির দূত পায়রাকে হত্যা কিংবা সাওতাল বাজিকরের বানর খেলা দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বিমোহিত করার মতো দৃশ্য। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে এসেও রয়েছে কবরস্থানের রূপকের আড়ালে সমগ্র দেশটাকে পরিশুদ্ধ করা কিংবা পরিচর্যা করার অগ্রণী শপথ গ্রহণের প্রত্যয়। ঔপন্যাসিকের ভাষ্য :
যে স্থানে আমাদের পূর্বপুরুষরা শুয়ে আছে, যেখানে আমাদের দাদা-দাদি, বাবা-মা, চাচা-চাচি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যেখানে আমি বা আমরা একদিন স্থায়ীভাবে ঠাঁই বা আশ্রয় নিবো, সেই পবিত্র ভূমির মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কবরস্থানটার সংস্কার প্রয়োজন। গোরস্থানটার সুষ্ঠু পরিচর্যা ভীষণ প্রয়োজন। এটা শুধু দায়িত্ব বা কর্তব্যের বিষয় নয়, এটা আমাদের আত্মিক ও বাহ্যিক তৃপ্তি, পরিতৃপ্তি, আনন্দ ও শুদ্ধি এবং জীবনের জন্যই জরুরি। যদি বাঁচি, এ যাত্রায় বেঁচে যাই. তবে নেতৃত্বটা নিজেকেই নিতে হবে। (মাওলা প্রিন্স, ২০২২ : ২৮৭)
বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি উপন্যাসে বর্ণিত কবরস্থানের প্রতীক ও রূপক সম্পর্কে ডক্টর কল্পনা হেনা রুমির বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য :
সংশোধন-অপেক্ষ যে কবরস্থানের ইংগিত বারবার আলোচ্য উপন্যাসে পাওয়া যায়, তা কেবল শব্দগত অর্থেই সীমাবদ্ধ নয়। এই কবরস্থান হয়ে ওঠে একাধারে মৃত বিবেকসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক সমাজ-ব্যবস্থার প্রতীক। এর সংস্কারবাসনার রূপকে মানবতার পুনরুদ্ধারই উপজীব্য। বংশপরম্পরায় তথা যুগের ধারাবাহিকতায় অনেকে এই সংস্কার করতে ইচ্ছুক হয়েও সফল হয়নি, কেউবা অগ্রসর হয়নি। কথক যেন তাই নিজেই সেই ভার তুলে নিয়ে হাজার বছরের মানবেতিহাসকে জরামুক্ত করতে চায়। চান। অধুনা করোনার কবলে আহত পৃথিবী কথকের এরূপ প্রতিশ্রুতির প্রয়াসে সবল হয়ে উঠুক, বার্তাটি পৌঁছে যাক সবার হৃদয়ে। (কল্পনা হেনা রুমি, ২০২২)
এভাবেই সমগ্র উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ঔপন্যাসিকের সর্বজ্ঞ জীবনদৃষ্টি। যা তাঁর উপন্যাসটিকে দান করেছে অনন্য মাত্রা। সমগ্র উপন্যাস পাঠেই বৌদ্ধিক পাঠক এরূপ জীবনঘনিষ্ট নানাবিধ বিষয়ে ঔপন্যাসিকের নিজস্ব ও অভিজ্ঞতালব্ধ উপলোব্ধির প্রকাশ দেখতে পাবে। অধ্যাপক ডক্টর শামীমা হামিদের মূল্যায়ন :
সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লেখাটা হয়ত সহজ, কিন্তু সেই সদ্যজাত ঘটনায় পাঠককে নিবিষ্ট করানোটা ততটাই দুরূহ— পাঠক ঘটনার স্থিতি চায়, জীবনের বহমানতা থেকে একটু সরে গিয়ে ফিরতে চায় হয়ত কোনো দুঃসহ স্মৃতিচারণায়! বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি উপন্যাসটিতে ঔপন্যাসিক মাওলা প্রিন্সের কৃতিত্ব করোনাকালীন সময়ের বাস্তবতা দুঃসহভাবে উপস্থাপন করতে চান নি তিনি; চেতনারীতির ধারায় সময়ের ক্রমবিন্যাস ভেঙেছেন এবং পাঠক-সমভিব্যাহারে পৌঁছুতে চেয়েছেন অতীতের স্বস্তিভূমিতে। (শামীমা হামিদ, ২০২৩)
করোনাকালীন সময়ে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে অতীত ও বর্তমানকে একই সরলরেখায় নিয়ে এসে জীবনের বহুকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গির এক শৈল্পিক সৃষ্টিকর্ম মাওলা প্রিন্সের বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি উপন্যাস। মহাকাব্যিক ধারার এই উপন্যাসটি একটি মহামারীকে ধারণ করলেও প্রকৃতঅর্থে এতে ঔপন্যাসিক দেখিয়েছেন একজন মানুষকে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে টিকে থাকতে হলে কিংবা আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে অথবা বেঁচে থাকতে হলে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে অনবরত যুদ্ধ করতে হয়। এ যুদ্ধ দৃশ্য-অদৃশ্য অনেক বিপক্ষ শক্তির সাথে, প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, দীনতা, অসুস্থতা, জরা, ক্ষয়, মৃত্যু ইত্যাদির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারাই শান্তি। জীবনবাস্তবতার নানান প্রসঙ্গকে চিত্রায়ণে, সংস্কারের দায়িত্ব নেওয়ার ব্রতে ও নেতৃত্ব প্রদানের প্রত্যয়ে ঔপন্যাসিক এখানে যথাযোগ্য সম্মানের দাবিদার। আঞ্চলিক শব্দচয়নে, প্রমিত বাক্যবিন্যাসে, অলংকারের নৈপুণ্যে, রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে, নিরীক্ষাপ্রবণতার নিষ্ঠায় এক অনন্য স্বাক্ষর যে তাঁর বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি এবং উপন্যাসটি যে বিস্ময় রকমের শিল্প-সফল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বহুমাত্রিক জীবনবীক্ষায় বিশ্বসাহিত্যে প্রশংসিত ওয়ার অ্যান্ড পিস, দি প্লেগ, লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা, ইউলিসিস ও ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড উপন্যাসের মতো কালজয়ী হোক বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি, —এমনটাই প্রত্যাশা।
আকর গ্রন্থ :
মাওলা প্রিন্স (২০২২), বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি, নৈঋতা ক্যাফে, ঢাকা
সহায়ক গ্রন্থ :
কুন্তল চট্টোপাধ্যায় (১৯৯৯), সাহিত্যের রূপ–রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, রত্নাবলী, কলকাতা
মাওলা প্রিন্স (২০১৯), কথাসাহিত্য পাঠ ও রূপতাত্তিক বিশ্লেষণ, মুক্তদুয়ার, ময়মনসিংহ
সহায়ক প্রবন্ধ :
কল্পনা হেনা রুমি (২০২২), ‘করোনাকালীন উপন্যাস বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি’, ওয়েবম্যাগ প্রতিকথা, www.protikokha.com
ফাহিদা সুলতানা (২০২২), ‘মাওলা প্রিন্সের বহুমাত্রিক উপন্যাস বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি’, ওয়েবম্যাগ শিশিরের শব্দ, ওয়ার্ডপ্রেস www.shishirershabdo.wordpress.com
মেহেদী ধ্রব (২০২২), ‘উপন্যাস পর্যালোচনা : মাওলা প্রিন্সের বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি’, ওয়েবম্যাগ দর্পণ, www.dorpon.com.bd
শামীমা হামিদ (২০২৩), ‘বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি : নিমগ্ন-চেতনায় শব্দযাত্রা’, অনুধ্যান, অনলাইন পত্রিকা, www.anudhyan.online
Discussion about this post