এর আগে বরমী বাজারে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি, এত সকাল থেকে কোনো সাপুরে, ভেলকিবাজ কিংবা ম্যাজিশিয়ান কালো রঙের তাঁবু গেড়ে বাদুড়ের খেলা দেখায়নি।
এর ফলে বরনল, বরকুল, সাতখামাইর, সোহাদিয়া, কাঁঠালী, ভিটিপাড়া, বালিয়াপাড়া কিংবা সিংহশ্রী থেকে বাজারসদাই করতে আসা মানুষ গোরুহাটার মোড়ে এসে বিহ্বল পাখির মতো চেয়ে থাকে এবং এইসব মানুষের মধ্যে একজন হেড মাস্টারও হাজির হন।
হেড মাস্টার দেখেন, কালো কালো চুলের তরঙ্গে সৃষ্ট বৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ষাট-সত্তর বছরের এক লোক আকাশের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করছে; লোকটার খাড়া নাক, সাদা চামড়া, লম্বা দাড়ি ও বাদামি রঙের চুলের কারণে দূরের মানুষ মনে হয়।
এর আগে দুই পর্ব খেলা দেখানো হয়ে গেছে, এইবার তৃতীয় পর্ব, এতে মানুষের সংখ্যা কমেনি, বরং কয়েকগুণ বেড়ে গেছে, নানা প্রান্ত থেকে নতুন নতুন মানুষের আমদানি হয়েছে, কাওরাইদ বাজারের লোকমান, ত্রিমোহিনীর শাহাবুল কিংবা শ্রীপুরের হাসিবুলরা পর্যন্ত চলে এসেছে।
এই পর্ব পর্বান্তর খেলা যেন একটা মওকা, এই মওকা কোনোভাবেই মিস করা যাবে না, তাই মানুষ বাড়ে আর বাড়ে।
খেলা শুরুর জন্য সব প্রস্তুত হলে লোকটা উপস্থিত মানুষের দিকে উদভ্রান্তের মতো চোখ ঘোরানো শুরু করে, তারপর হাত নাড়তে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে পাঁচটা বাদুড়।
হেড মাস্টার লক্ষ্য করেন বুধবারে, মানে হাটের দিনে চতুর সাপুড়েরা মজমা বানিয়ে যেভাবে সাপের খেলা দেখায়, সেভাবে নয়, বরং পাঁচটা বাদুড় বিচিত্র সব কেরামতি করে, সাপের মতো না পালিয়ে সন্ত্রাসী ঝড়ের মতো মানুষের মাথার ওপরে উড়ে বেড়ায়।
লোকটার বাম পাশে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে কালো চশমা পরা এক পুরুষ, ডান পাশে সাজানো সারি সারি কাঠের বাক্সের ভেতর থেকে আসে কিচিরমিচির শব্দ।
তখন দেহে আগুনের উত্তাপ নিয়ে অপূর্ব সুন্দর চেহারার এক নারী সবুজ ঘাসে দাগ কেটে সীমানা নির্ধারণ করে, সাপুড়েরা যেভাবে সীমানা নির্ধারণ করে, যে সীমানা অতিক্রম করলে রক্তবমি করে মরতে হবে কিংবা পেছন পেছন ধাওয়া করবে আগুনের গোলা।
লোকটা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা শুরু করে :
আমি যে খেলা দেখাব তা সাধারণ কোনো খেলা না, আর আমি মাগনা খেলা দেখাই না, খেলা শেষ হলে আপনাদের মাথার ওপর উড়তে থাকা পাঁচটা বাদুড় আপনাদের পাঁচজনের কাছে যাবে, যার কাছে যাবে তার সাথে যা থাকবে তা দিয়ে দিতে হবে; এটা হলো বাদুড়ের নজরানা, আপনারা যারা এই শর্তে রাজি আছেন তারা বসেন, যারা রাজি নন তারা চলে যান, আপনাদের অনুরোধ করছি, রাজি না থাকলে চলে যান।
হেড মাস্টার অবাক হয়ে দেখেন, লোকটার কথায় অদ্ভুত এক শক্তি, কথার ধরন শুনে মনে হয় নিজের অধীনে কর্মরত চাকরদের নির্দেশ দিচ্ছে।
লোকটার শর্তে কোনো মানুষ চলে যাচ্ছে না, হয়ত বাদুড়ের খেলা দেখার মোহ বা লোভ পেয়ে বসেছে অথবা তারা যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তির মায়াজালে আটকা পড়েছে।
বাদুড়ের খেলা শুরু করার আগে লোকটা আবারও মানুষের দিকে বর্শার ফলার মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাম হাতের বৃদ্ধাঙুলের ইশারায় কাঠের বাক্সের ঢাকনা খুলে ফেলে, আর ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় বের হয়ে পূর্বের পাঁচটা বাদুড়ের সঙ্গে একাকার হয়ে লোকটার মাথার ওপরে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে।
মুহূর্তের মধ্যে মানুষের মোহ ধরে, তারপর আঙুলের ইশারা পেয়ে বাদুড়গুলো তির তির করে পেছাতে থাকে আর আস্তে আস্তে বৃত্তের পরিধি বড়ো হতে থাকে, একসময় বাদুড়ের বৃত্তের পরিধি মানুষের বৃত্তের পরিধির সমান বড়ো হয়ে যায়।
লোকটা আবারও ইশারা করে, চোখের পলকে বাদুড়ের বৃত্তের পরিধি মানুষের বৃত্তের পরিধির ওপরে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে, মানুষ মৃতের মতো নিস্তব্ধ হতে থাকে।
তখন লোকটা পকেট থেকে আতরের শিশি বের করে আশ্চর্য এক গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে চোখের তারা নাচায়, আর সঙ্গে সঙ্গে বাদুড়গুলো পাখা মেলে বিচিত্র সব খেলা প্রদর্শন করে। এতে কেউ কেউ ঘন ঘন প্রশ্বাস ফেলে, শিশু-কিশোররা বড়োদের হাত চেপে ধরে।
লোকটা এই দৃশ্য দেখে চোখে-মুখে তৃপ্তি ও উত্তেজনা নিয়ে আঙুল নাচাতে থাকে আর বাদুড়গুলো চড়কির মতো ঘুরতে ঘুরতে কাঠের বাক্সের ভেতরে ঢুকে পড়ে, কিন্তু পাঁচটা বাদুড় মাথা বরাবর উচ্চতায় উড়তে থাকে।
লোকটার সঙ্গে থাকা পুরুষ ও নারী সোনালি রঙের বস্তার মুখ খুলে বসে থাকে আর লোকটার ইশারায় প্রথম বাদুড় ময়লা শাড়ি পরিহিত এক মহিলার কাছে ছোটে, খেটে খাওয়া এই মহিলার কাছে একটা সাদা পলিব্যাগ, তাতে হয়ত আছে কয়েক কেজি মোটা চাল, বাদুড়টা উড়ে উড়ে সেই মহিলার মুখের কাছে পাখা ঝাপটায়।
লোকটা হুংকার দিয়ে বলে,
– নজরানা হিসেবে আপনার চালগুলো দিয়ে দেন।
মহিলা কাচুমাচু করতে থাকে, ততক্ষণে বাদুড়টা মহিলার হাত থেকে চালের ব্যাগটা কেড়ে নেয়, সামান্য এক বাদুড় তা নখে ঝুলিয়ে হরিণ শিকারী বাঘের মতো ছোটে, তারপর ব্যাগটা নারীর হাতে দিয়ে বাক্সের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
হেড মাস্টার বোঝার চেষ্টা করেন, ওনার মনে পড়ে খেলা শুরু করার আগের শর্তের কথা, তাই মহিলার কাছ থেকে ব্যাগ কেড়ে নেওয়ার সময় ওনার ভেতরটা নড়েচড়ে ওঠে, উনি কৌশলে ওনার মানিব্যাগ আড়াল করে রাখেন; ওনার মনে হয়, ছোটবেলা থেকে বরমী বাজারে কত খেলা দেখেছেন, কত জাদু দেখেছেন, কিন্তু এমন মোহনীয় খেলা জীবনে দেখেননি।
লোকটা দ্বিতীয় বাদুড়কে ইশারা করে, বাদুড়টা পাখা দোলাতে দোলাতে এক কিশোরীর কাছে পোঁছে, মহিলার ঘটনা থেকে কিশোরী বুঝতে পারে কিছু একটা দিতে হবে, কিন্তু দেওয়ার মতো কিশোরীর কাছে কিছুই নেই, লোকটা ইশারা করলে বাদুড়টা কিশোরীর বুকের ওড়নাতে খামচে ধরে, অবস্থা বুঝে সে ওড়না ফেলে বুকে দুই হাত চেপে ঊর্ধ্বশ^াসে পালায়, আর বাদুড়টা ওড়না নিয়ে পুরুষের হাতে দিয়ে বাক্সে ঢুকে পড়ে।
এই দৃশ্য দেখে অনেকে কাঁপতে থাকে, কেউ কেউ জেদে ফেটে পড়ে, হেড মাস্টারের বুকে বিষের ছুরি বিঁধে, কিন্তু উনি লক্ষ্য করেন, পশ্চিম থেকে কালো কালো মেঘ ও সাপের মতো অন্ধকার ধেয়ে আসছে, খেলা দেখতে আসা মানুষও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে, কেউ কেউ পালাতে চায়, কিন্তু কারো পা নড়ে না, তাদের মনে হয় নজরানা না দিয়ে চলে গেলে বাদুড়গুলো পেছন পেছন ছুটে যাবে, হিংস্র পশুর মতো নাকে-মুখে-চোখে-ঘাড়ে আঁচড় বসিয়ে দিবে।
তৃতীয় বাদুড় তিরতির করে এক শিশুর মাথার ওপরে ওড়াউড়ি করে, শিশুটি ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে, শিশুর হাত ধরে রাখা ব্যক্তি পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, সেও দমে গেছে; কারণ, শিশুটির হাতে একটা কুঁড়েঘর, এই কুঁড়েঘরটা কিছুক্ষণ আগে মেলা থেকে কিনে আনা হয়েছে। কিন্ত ইশারা পেয়ে বাদুড়টা ধারালো নখে খামচা দিয়ে শিশুটির হাত থেকে কুঁড়েঘরটা কেড়ে নেয়, শিশুটি ডুকরে কেঁদে ওঠে।
এই দৃশ্য দেখেও মানুষ আঁতকে ওঠে, হেড মাস্টারের বুকের বাঁ পাশের ব্যথা বাড়ে।
চতুর্থ বাদুড় ইশারা পেয়ে চোখের পলকে স্কুল ড্রেস পরা এক কিশোরের চোখের সামনে নাচানাচি করে, কিশোর ফোঁপাতে ফোঁপাতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের হাত চেপে ধরে, কিন্তু বাদুড়টা কিশোরের কাঁধে ঝুলানো স্কুল ব্যাগে খাব্লা দিয়ে ধরে, কিশোর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
এই দৃশ্য দেখেও মানুষ কষ্ট পায়, যুবকদের চোখ দিয়ে ভাপ বের হতে থাকে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না, হেড মাস্টারের কপালেও বিদ্রোহের ভাঁজ দেখা যায়।
পঞ্চম বাদুড় ফনফন করে ঘুরে এক বৃদ্ধের মাথার কাছে ডিগবাজি খেতে থাকে, বৃদ্ধের হাতে ওষুধের ঠোঙা, তাতে আছে জরুরি ওষুধ, কিন্তু বাদুড়টা ছো মেরে ঠোঙাটা কেড়ে নিয়ে নারীর হাতে দিয়ে বাক্সে ঢুকে পড়ে।
এইবারও মানুষ ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়ে, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছুই বলে না, তখন লোকটা বলে আজকের মতো মজমা শেষ, কাল আবার খেলা দেখানো হবে।
এতে মানুষের চোখে-মুখে উত্তেজনা, বিস্ময়, রাগ ও ঘৃণা দেখা যায়; কিন্তু হেড মাস্টারের মগজে গেড়ে বসে বাদুড়ের ঘটনা; ওনার মনে হয়, যে করেই হোক বাদুড়ের রহস্য ভেদ করতে হবে; কারণ, বাদুড়ের খেলাকে জাদু বা মায়া মনে হচ্ছে না, নিশ্চয় কোথাও একটা ফাঁকি আছে, কিন্তু উনি ধরতে পারছেন না।
পশ্চিম আসমানে মেঘেরা লুটোপুটি খায়, হাড়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে কনকনে হাওয়া। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস সত্যি হয়, টুপ টুপ করে পড়ে বৃষ্টির ফোঁটা, তাড়া খাওয়া মাছের মতো মানুষের পায়ে পায়ে ঘরে ফেরার তাড়া, শূন্যে ভেসে চলা পাখিদের পাখনায়ও নীড়ে ফেরার তাগাদা।
লোকটার সঙ্গে থাকা পুরুষ ও নারী তাঁবুর ভেতরে ছোটে, কিন্তু হেড মাস্টার লোকটার পিছু ছাড়েন না, ওনি পণ করেছেন, বাদুড়ের রহস্য ভেদ না করে কোথাও যাবেন না; ছলে-বলে-কৌশলে, প্রয়োজনে হাতে-পায়ে ধরে হলেও প্রকৃত ঘটনা জানবেন।
অন্ধকার নিশ্চুপ হতে থাকে, খোলা হাওয়া বাড়তে থাকে, বৃষ্টির ফোঁটা বড়ো হতে থাকে, ততক্ষণে লোকটা তাঁবুর ভেতরে চলে গেছে, হেড মাস্টারও তাঁবুর ভেতর ঢুকেন, লোকটা হেড মাস্টারের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘আসুন, হেড মাস্টার সাহেব, আসুন।’
হেড মাস্টার কিছুটা ঘাবড়ে যান, লোকটা ওনাকে চেনে কীভাবে? লোকটা আবরও বলতে থাকে, ‘আমি জানি, আপনি কী চান, আপনি আপনার গল্প-উপন্যাসের জন্য হলেও বাদুড়ের ইতিহাস জানতে চান, তাই না? শুনেন হেড মাস্টার সাহেব, আমি জানি, আপনি পৃথিবীর ইতিহাস জানেন, এখন বাদুড়ের ইতিহাস জানতে চান, যদিও আমি কাউকে বাদুড়ের ইতিহাস বলি না, তারপরও একটি বিশেষ কারণে আপনাকে বাদুড়ের ইতিহাস জানানো হবে, কিন্তু ইতিহাস আমি বলব না, যেহেতু ইতিহাস বাদুড়ের, সেহেতু বাদুড়ই আপনাকে ইতিহাসটা বলবে।’
হেড মাস্টার চিন্তাও করেননি এই রকম কিছু হবে বা এই রকম কিছুর মুখোমুখি হবেন, উনি লক্ষ্য করেন, কয়েকটা বাদুড় নখে ঝুলিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে আসছে।
লোকটা বলে, ‘বসুন হেড মাস্টার সাহেব, বসুন।’
হেড মাস্টার দোটানার মধ্যে পড়েন, লোকটার মুখের দিকে দেখেন, লোকটা মুচকি হাসে, আর হেড মাস্টার সঙ্গে সঙ্গে দপ করে চেয়ারে বসে পড়েন।
লোকটা জানায় যে, এই চেয়ার নীল ময়ূরের পালক দিয়ে বানানো হয়েছে, এটাতে কেউ বসলে সহজে উঠতে চায় না।
কথা সত্য, হেড মাস্টারেরও উঠতে ইচ্ছে করে না, কেমন নেশা ধরে গেছে।
লোকটা হেড মাস্টারকে বলে, ‘হেড মাস্টার সাহেব, আরাম করে বসুন, ইতস্তত করবেন না, এই চেয়ারটা আপনার জন্যই, আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ারে বসে থাকতে হয়, আপনার তো লেখার শেষ নেই, কত কী লেখেন, আমি বুঝতে পারছি, এই চেয়ারটা আপনার হলে সুবিধা হয়, সমস্যা নেই, আমার বাদুড় সম্প্রদায় আপনার বাসায় চেয়ারটা দিয়ে আসবে, চিন্তা করবেন না, কেউ কিছুই জানতে পারবে না।’
হেড মাস্টারকে কিছুটা আত্মস্থ মনে হয়, চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে লোকটার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন, লোকটা মুচকি হেসে আঙুল দিয়ে ইশারা করে, কয়েকটা বাদুড় একটা বোতল এনে হেড মাস্টারের নাকের সামনে ধরে, আর লোকটা বলতে থাকে, ‘হেড মাস্টার সাহেব, একটু শরাপ পান করেন, ভালো জিনিস, ভোটের পরের দিন চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে যেটা খেয়েছিলেন সেটার চেয়েও ভালো, নিন, একটু চেখে দেখুন।’
হেড মাস্টারের ভেতরটা আতকে ওঠে, এই লোক তো সাংঘাতিক, পেটের সব খবর জানে, কীভাবে সম্ভব? কে এই লোক?
শঙ্কা ও ভয় হেড মাস্টারকে কব্জা করে ফেলে, লোকটা আবারও শরাপ নিতে বলে।
হেড মাস্টার আমতা আমতা করে শরাপে মুখ দিয়ে মুগ্ধ হন; ওনার মনে হয়, এই রকম জিনিস জীবনেও চেখে দেখেননি, কলিজাটা গভীর সুখে ও অদ্ভুত তৃপ্তিতে ভরে যায়, তখন আস্তে আস্তে ওনার চোখ ছোট হয়ে আসে, ঢুলুঢুলু চোখে দেখেন একটা বাদুড় কথা বলছে :
আমি বাদুড়ের সর্দার, আমি আমাদের ইতিহাস কইতাছি, এইটা গল্পের মতো শুনাইলেও আসলে গল্প না, আমাদের সত্যিকারের ইতিহাস কইতাছি, এইটা একদম সত্যি, চন্দ্র সূর্যের মতন সত্যি, অনেক অনেক বছর আগের কথা, আমরা থাকতাম পুবের দিকে, সেইখানে একটা গাঙ ছিল, গাঙের কিনারে অনেকগুলা বটগাছ ছিল, সেই বটগাছে ছিল আমাদের বাসা, আমাদের সুখের সীমা ছিল না, আমরা লোকালয়ে গিয়া গাছের ফল-ফলান্তি চুরি করতাম, রোগ-বালাই নিয়া ছড়াইয়া দিয়া আসতাম, কিন্তু একদিন মানুষ আমাদের ওপর চড়া হইয়া উঠল, সব বট গাছ কেটে ফেলল, আমাদের বাসা পোড়াইয়া দিল, বাসা হারাইয়া আমরা উড়তে উড়তে ক্লান্ত হইয়া পড়ি, হঠাৎ কইরা দেখি একটা মানুষ আমাদের হাত দিয়া ইশারা কইরা ডাকতাছে, আমরা প্রথমে ডরাইয়া যাই, তাই যাইতে চাই না, পরে যখন বুঝতে পারি মানুষটা আমাদের ক্ষতি করবে না তখন যাই, মানুষটা আমাদের আশ্রয় দেন, কিন্তু আমাদের একটা শর্ত দেন, অন্য কোনো মানুষ কোনোভাবে যাতে জানতে না পারে, আমরা মানুষটার বাড়িতে লুকাইয়া থাইকা আবারও লোকালয়ে যাই, খাওন-দাওন সব কিছু নিয়া আসি, আমরা খুশিতে মানুষটারে কিছু করতে দেই না, মানুষটা শুইয়া বইসা সময় কাটাতে থাকল, এইভাবে অনেক দিন চলে যায়, একসময় মানুষটা মইরা যায়, কিন্তু আমরা যারা বাদুড় তাদের বংশ অনেক বড়ো, কারণ, আমাদের মৃত্যু নাই, মানুষটা মরার পরে আমাদের দায়িত্ব বুঝে নেয় মানুষটার একমাত্র উত্তরসূরি, কিন্তু এই উত্তরসূরি তার পূর্বসূরিকে ছাড়াইয়া যায়, কত চিন্তা, কত ছদ্মবেশ যে ধরে, কত কী যে করে, আমাদের নিয়া দেশে দেশে ঘুইরা বেড়ায়, কোনো কিছুর অভাব নাই, তাও মানুষদের খেলা দেখায়া এইটা সেইটা কাইড়া নেয়, আমরাও কত কিসিমের মানুষ দেখি, আমাদের কাছে মানুষের হাড়ির খবর পর্যন্ত থাকে, বেকুব মানুষ এইসবের কিছুই জানে না, আমরা হাসি আর দেখি, বিরাট মজা পাই, আমাদের ওপরে কেউ নাই, আমরা যা চাই তাই পাই, আমাদের সুখের সীমা নাই।
হেড মাস্টারের চোখ লেগে গেছে, তাই বাদুড়ের সব কথা শেষ হবার আগেই ঘুমিয়ে পড়েন এবং একসময় মানুষের হট্টগোলে ওনার ঘুম ভেঙে যায়; কিন্তু ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরে ওনার মনে পড়ে না কিছুই, এখন রাত না কি দুপুর না কি সন্ধ্যা, এখন কোথায় আছেন, আগে কোথায় ছিলেন, কিন্তু মানুষের হট্টগোল বাড়তে থাকে, উনি উপুড় থেকে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন, চিৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ চিৎকার করতে করতে কাছে আসতে থাকে, ‘আরে, উনি তো আমাদের হেড স্যার, স্যার, স্যার, আপনার কী হইছে? এইখানে এইভাবে শুইয়া আছেন কেন?’
হেড মাস্টার চোখ খুলে দেখেন ওনাকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, যারা ওনার কাছে আসে তাদের একজন বলে, ‘স্যার, আমি বিস্ময়, আপনার ছাত্র, স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন? স্যার, আমি বিস্ময়, আমরা বাদুড়ের খেলা দেখতে আসছিলাম, এসে দেখি একজন লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে, আমরা ভাবছি বাদুড় দিয়ে যে লোকটা খেলা দেখাচ্ছিল সেই লোক পড়ে আছে, নইলে মরে গেছে, আপনাকে ওই রকমই দেখাচ্ছিল, কিন্তু পরে আপনি যখন উপুড় হওয়া থেকে চিৎ হইলেন তখন দেখি আপনি, আপনার কী হয়েছে স্যার?’
হেড মাস্টার সচেতন হয়ে পড়েন, ঝড়ের বেগে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেন, ওনি লক্ষ্য করেন সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে সব, সঙ্গে সঙ্গে রাতের কথা মনে পড়ে, লোকটা কোথায়? তাঁবুটা কোথায়?
হেড মাস্টার চট করে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক খুঁজেন; না, কোথাও কোনো চিহ্নও দেখা যায় না; তখন বাদুড়ের কথা মনে পড়লে মাথা ঝিম ঝিম করে, মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন যেন, এই বুঝি মুখ ভরে বমি চলে আসবে, তখন মগজের ভেতরে বাদুড়ের পাখা ঝাপটানোর শব্দ হয়, নাকে আসে উৎকট গন্ধ।
হেড মাস্টার মানুষের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন, ওনার কাছে সবকিছু অবিশ^াস্য ও স্বপ্নের মতো লাগে, রাতের বিষয়টাকে জমানো দুঃস্বপ্ন মনে হয়, অথবা হতে পারে সবকিছু মস্তিষ্কের উদ্ভট চিন্তা বা অবচেতন মনের কল্পনা বা হ্যালুসিনেশন, কিন্তু এইসব ভেবেও ভেতরটা শান্ত হয় না, তখন মনে পড়ে অমীয় স্বাদের সেই শরাপের কথা; সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চেটে উত্তেজিত হয়ে পড়েন; কারণ, এখনো অটুট আছে অপূর্ব সেই স্বাদ, কিন্তু পরক্ষণেই আরও বেশি উত্তেজিত ও চনমনে হয়ে ওঠেন; কারণ, মনে পড়ে গতকাল রাতের সেই নীল ময়ূরের পালক দিয়ে বানানো চেয়ারের কথা।
হেড মাস্টার অস্থির হয়ে পড়েন, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মানুষের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসেন।
তখন পশ্চিম থেকে ঝির ঝির করে হাওয়া আসে, পায়ের পেশিতে শক্তি আসে, মনের আদি-অন্তে জোর আসে।
হেড মাস্টার অন্তরে অসীম প্রত্যাশা, বমি বমি ভাব ও উৎকট গন্ধ নিয়ে বাসার দিকে ছুটে চলেন।
Discussion about this post