ঈশ্বর দাস চমকে উঠল। আশেপাশে ডানে-বায়ে কোথাও কেউ নেই। ‘কথাটা তাহলে বললো কে?’
আবার আকাশের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল। নাহ্, দিনে-দুপুরে আকাশেও তো কোনো ছিদ্র দেখা যাচ্ছে না।
দুই ঘন্টা আগে তার জীবনে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তা সে ঘটনা জানে একমাত্র ঈশ্বর দাস আর চিত্রগুপ্ত, যমরাজের ডান হাত যে।
সকাল সাতটায় হাঁটতে বেরিয়ে আচমকাই কদমতলার কাছে গিয়ে বুকটা পিনপিন করে উঠল। কিসে যেন সুঁচ ফোটাল ঘাড়ের কাছে আর তারপরই কোথা থেকে যে কি ঘটে গেলো! বিজ্ঞানের জ্ঞান কম থাকায় বুঝতেই পারেনি সাধের হার্টটা অ্যাটাক হতে যাচ্ছে। জ্ঞান হওয়ার পর কোথায় কদমতলা আর কোথায় আগরতলা!
‘এ-বাবা, এ আবার কোথায় এসে পড়লাম! ’
হেলেদুলে ঢাউস লাল রঙা খাতা নিয়ে এক লোক হাজির। ‘তোর টাইম শেষে রে উজবুক, মুখটা বন্ধ করে বসে থাক দিকিনি এখন।’
‘বললেই হলো! অ্যাঁ, কিসের টাইম শেষ! আমি তো কোনো রেসে নাম লিখাইনি। আর আপনিই বা ঘোষণা করার কে বে যে আমার টাইম শেষ।’
‘আহ্, এতো দেখি অতিরিক্ত কথা বলে! চুপ, চুপ। একদম একেবারে চুপ বেশি কথা বললে আমার হিসেবনিকেশে ঝামেলা হয়ে যায়। আর এখন তো তোর পাপপুণ্যের হিসাবই করছি। ঝামেলা করিসনে।’
তোর পাপের ঘড়া যে একবারে কানায় কানায় পূর্ণ, তাও ছিঁচকে পাপ দিয়ে। ছোঁ, করবি যখন বড়সড় কিছুই করতি। খুচরা পাপে লিস্টি ভরা।’
ঈশ্বর দাস থতমত খেয়ে গেলো। এ বলেটা কি! যা বলে তাই মেনে নিবে নাকি? মামুর বাড়ির আবদার নাকি, এ্যাঁ!
‘আমার পাপপুণ্যের হিসাব করতে আপনাকে কে বললো? আর.. আর.. আমার কোনে পাপ-টাপ নেই। জ্ঞানত আমি কোনো পাপ করিনি। ছা-পোষা কেরানি পাপ কোথা থেকে করবে তা কি আপনার বিবেচনায় আসে না? ’
‘তবে রে মিথ্যাবাদী, প্রবঞ্চক- আমার সাথে চালাকি! আমি চিত্রগুপি, হিসাব ছাড়া কথা কইনে, মজা টের পাওয়াচ্ছি তোকে।’
কখন থেকে লোকটা লাল খাতা নিয়ে যাচ্ছে তাই বকেই যাচ্ছে। এ তো আর সহ্য করা যাচ্ছে না। একটা বিহিত করতেই হয় এর। কনুই এ ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে টের পেল চারদিকে সব কেমন সাদা সাদা, একটু অস্বাভাবিক সাদা।
ঈশ্বর দাস সামনে তাকাল। ওই হোঁৎকা লোকটা লাল খাতা নিয়ে কেমন মিটিমিটি হাসছে। হচ্ছে টা কি এসব! হোঁৎকাকে কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে, ভালো করে দেখার পর মনে হলো তার অফিসের ক্যাশিয়ার সুবিমল বাবুর সাথে নিজেকে চিত্রগুপ্ত না ফিত্রগুপ্ত দাবি করা লোকের মিল আছে। আশ্চর্য তো!
চারদিকে তাকিয়ে এবার সত্যিই মনে হলো সে আর নেই। আর সে পৃথিবীতে নেই। সুবিমল বাবু বেঁচে থাকতেও জ্বালিয়ে মেরেছে, এখন মরেও শান্তি নেই। ও বেটা এখন চিত্রগুপ্তের জায়গা দখল করে বসে আছে।
চিন্তার জাল কেটে গেল সুবিমল বাবুর চিৎকারে। না না চিত্রগুপ্তের চেঁচামেচিতে। এই এক ঝামেলা হলো এখন, চিত্রগুপ্তের মুখখানা সুবিমল বাবুর মতো হওয়ায় কিছুতেই মনে শ্রদ্ধা, ভক্তি জাগছে না।
‘জোচ্চর, মিথ্যাবাদী- নরকেও তোর ঠাঁই হবে না।’
‘না হলে না হলো। নরকে জায়গা না হলে স্বর্গে যাব। তাই না?’
চিত্রগুপ্ত ভিলেন হাসি হেসে বলল, ‘আহা,আস্তাকুঁড়ের এঁটোপাতা সর্গে যাওয়ার আশা গো! তোর জন্য দুয়ার খুলে বসে আছে, যা যা।’
মুখে ভিলেন হাসি ঝুলিয়ে বলে চললো, ধানাইপানাই বকে আর কোনো লাভ নেই, ওইতো যমরাজ আসছে। তোর মতো বাঁদরকে কোথায় পাঠাতে হবে তা কি আর জানা নেই!’
ঈশ্বর দেখলো আসলে আর কোনো পথই খোলা নেই। এবার তাহলে সাক্ষাৎ নরক! নরকে যাওয়ার কোনো পথই যে বন্ধ নেই।
একটু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে দেখাই যাক না গুপ্ত মহাশয়কে।
‘নরকে যেতে আমার আপত্তি নেই। জ্ঞানত আমি কোনো পাপ করিনি আর যদি করেই থাকি তা অন্যের পরামর্শে। আমার মন চাকা সাবানে ধোয়া সফেদ কাপড়ের মতো
ঝকঝকে, তকতকে।’
‘তাই নাকি রে! পড়ে পড়ে শুনাই তবে তোর কীর্তি। শুরু করলাম তবে—’
ঈশ্বর দাস এবার ঘাবড়ে গেলো। সত্যি সত্যি মরে গেলে তো ভালো বিপদ। কান্না কান্না গলায় বলে উঠল, ‘আমার খুকির ইস্কুল ফি টা আজ দিতে হবে, কেউ তো জানে না আমি কোথায় কি রেখে এসেছি।’
‘ওরে থাম থাম। তোর কথা শুনে মনটা কেমন হুহু করে উঠল।’
ঈশ্বর মনে একশ ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠল । এভাবে আর কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান করলে একসময় বিরক্ত হয়েই তাকে পৃথিবীতে কি ফেরত পাঠাবে না? চিত্র বেটা দেখতে সুবিমলের মতো হলে কি হবে মনটা নরম পাউরুটির মতো। এত নরম মন নিয়ে যমালয়ে কাজ চলে নাকি!
ছলছলে চোখ নিয়ে অভিমানে ভারী গলায় বললো, ‘ আমার বুড়ো বাপটা আজ রসমালাই খেতে চেয়েছিলো, আমি ছাড়া বাজারের সেরা রসমালাই কে নিয়ে যাবে গো —’
‘আহা,থাম থাম। এই হলো এক সমস্যা তোদের, ‘যতদিন বেঁচে থাকিস ততদিন দিনে একশবার মন্ত্রের মতো ঝপতে থাকিস, এত লোকের মরণ হয়, আমার কেন হয় না। যখন মরলি তখন হাজারটা বায়ান্নাকা।’
‘এ্যাঁ, খামোখা মিথ্যা দোষ আমার উপর চাপাবেন না। বেঁচে থাকতে আমি ঘূর্ণাক্ষরেও মরার নাম মুখে আনিনি । আমার কত কাজ বাকি, দিন না ছেড়ে!’
চিত্রগুপ্ত তেমন একটা পাত্তা দিল না কথার। এমন কথা বজ্জাত মরা গুলো হরহামেশা বলে থাকে। তার মাথায় একটা গান ঘুরছে কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে গানটা কার। ‘কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে’ তারপরের লাইনটা কি কিছুতেই মাথায় আসছে না।
এদিকে ঈশ্বর দাসের ঘ্যানঘ্যান ক্রমাগত অসহ্য হয়ে উঠেছে। খাতায় চোখ বুলিয়ে বিরক্তি তে চিত্রগুপ্তের ভ্রু কুঁচকে উঠল, ‘এ শালার পুরো জীবনই খুচরো পাপে ভরা’। পাপের তালিকায় উপর থেকে নিচে একবার চোখ বুলালো। কি নেই তালিকায়! ছোঃ, ঘেন্না এসে গেল ছিঁচকে চোর বেটার উপর।
‘ বাপের বাটি থেকে রসমালাই চুরি করে খাওয়া, খুকির স্কুল ফি’র নাম করে বউয়ের হাত ব্যাগ থেকে টাকা মেরে দেওয়া, বাজারে মানুষের ভিড়ে পকেটে পেঁয়াজ, মরিচ সাঁটিয়ে দেওয়া, পরস্ত্রীর দিকে ডুবো ডুবো চোখে তাকিয়ে থাকা—অতটুকু অবধি বলে শ্বাস নিলেন চিত্রগুপ্ত।
তোর পাপের লিস্টি বলে বলে মুখ অশুদ্ধ হয়ে গেলো। তুই তো বেঁটা ছিঁচকো চোর, মহাচোর ও না। তোকে ফেলবটা কোথায়? নরকে যাওয়ার জন্যও এখন একটা যোগ্যতা লাগে।’
ঈশ্বরের মনে লাড্ডু ফুলে উঠল। বাইরে চেহরা বিমর্ষ রেখেই বললো, ‘তাহলে আমায় ছেড়ে দেওয়া যায় না? আমায় আটকে রেখো খামোখা নরকে কৃত্রিম সংকট কেন তৈরি করবেন মহাশয়! ইহলোকে গিয়ে আরেকটু পাপ কামিয়ে আসি, খামোখা এখানে সময় নষ্ট করে কি লাভ, বলুন আপনি।’
প্রস্তাবটা চিত্রগুপ্তের কাছে খারাপ লাগল না৷ সব ব্যাটা তো ছাড়া পাওয়ার জন্য মিথ্যা বুলি আউড়ে্ যায়। ‘ছেড়ে দিলে পৃথিবীতে গিয়ে মহাপুণ্য করে মহাপুরুষ হয়ে আসব।’ সব ব্যাটা ফটকাবাজ। এই ঈশ্বর বেটা বলেছে সত্যি কথা। যাক কিছুটা পাপ কামিয়ে আসুক,তারপর না হয় জায়গামতো সাইজ করা যাবে। তবে কি না এত সহজে ছেড়ে দিলে দাম ও থাকে না। আরেকটু খেলিয়ে নিলে হয়।
ঈশ্বর দাসের আর তর সইছে না৷ ছাড়বে কখন! গুপ্ত সাহেব যে ঝিম ধরে গেলেন। অধৈর্য গলায় বললো, ‘কি অতো ভাবছেন মহাশয়? সত্যি বলছি, আরো বড় বড় পাপ জমিয়ে নরকেই ডুকবো। অনেক পাপ করা বাকি শুধু একবার যেতে দিন দয়া করে।
চিত্রগুপ্ত খাতাটা বন্ধ করে দু’বার ভাবলেন। নরকে জায়গা সংকট দেখা দিচ্ছে। বড় বড় রুই-কাতলাগুলো ইদানীং ঝাঁকে ঝাঁকে মরছে। এদের জন্য সাধারণদের জায়গা হচ্ছে না, মরা গুলো পড়ছে বিপদে। কিছুদিন আগে কিসিঞ্জার মরে নরকের বড়সড় জায়গা দখল করে নিয়েছে। এখানে চুনোপুঁটি ঈশ্বরদের জায়গা কোথায়!
যাক বেটা। আরেকটু পাপ-টাপ করে আসুক। যেমন ছিঁচকে চোর, এর জন্য তো স্বর্গ দ্বার খুলে বসে থাকবে না।
‘তাহলে কি সিদ্ধান্ত নিলেন? আমি যাব?’
চিত্রগুপ্ত গলায় উষ্মা ঢেলে বললেন, ‘যা বেটা ফট।’
এর বেশি কিছু মনে নেই ঈশ্বর দাসের। তারপর আবার কদমতলা আর সেখান থেকে ঘর আর ঘর থেকে হাতে বাজারের থলে।
বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে আকাশের দিকে কয়েকবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল ঈশ্বর৷ নাহ্,আকাশে কোনো ছিদ্র-ফিদ্র নেই। আরো বড় বড় চুরি করতে হবে এখন। দেশে এত ঘাগু চোর মনে হয় না এদের সাথে টেক্কা দিয়ে পারবে। তা চেষ্টা করতে দোষ কি! ঈশ্বর দাস এবার শেষ চেষ্টা করবে। যদি থাকে কপালে!
Discussion about this post