মির্জা মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূর
স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতে হলে পারস্পরিক হৃদয়ে অনাবিল প্রেম-ভালোবাসার উপস্থিতি কাম্য। প্রেমহীন জীবন ধূসর মরুভূমির মতো। প্রেম আছে বলেই পৃথিবী এতো সুন্দর, এতো প্রেমময়, এতো মায়াময়। প্রেমহীন জীবনের কোন মূল্য নেই। যেখানে প্রেম আছে সেখানেই বিরহের যন্ত্রণা আছে। প্রেম আর বিরহ আছে বলেই পৃথিবী এতো সুন্দর, এতো বৈচিত্র্যময়।
আলো-অন্ধকারের সংমিশ্রণে ভালো-মন্দের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শুধু আলো দিয়ে ভালোর গুরুত্ব বোঝা যায় না, এজন্য প্রয়োজন অন্ধকারের। ঠিক তেমনি প্রেম-ভালোবাসার গুরুত্ব বুঝতে হলে বিরহের অনলেও পুড়তে হয়। প্রেম-ভালোবাসার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি না বলেই আমাদের মাঝে এতো ভাঙন, এতো কলহ-দ্বন্দ্ব-বিভেদ। প্রেম-ভালোবাসা হচ্ছে এক ধরনের আবেগ, অনুভূতি বা প্রাপ্তির আকুলতা। যা মানুষকে অসাধ্যকে সাধ্য করতে সহযোগিতা করে, অনুরণিত করে, লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে উদ্ভুদ্ধ করে। এজন্য প্রেম-ভালোবাসার ভালো-মন্দ দিক সম্পর্কে জানা জরুরি, ওয়াকিবহাল হওয়া প্রয়োজন। যা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সফল প্রেমিক হতে সহযোগিতা করবে।
কথায় আছে, লুকোচুরিতেই প্রেমের আসল আনন্দ। যেদিন থেকে প্রেম স্বীকৃতি পেয়ে যায় সেদিন থেকেই প্রেমের আনন্দ চলে যায়। কারো কারো মতে, যে ভালোবাসার মাঝে হারানোর ভয় থাকে আর সে কথা ভেবে ভেবে দুজনেই কাঁদে, সে ভালোবাসা হচ্ছে প্রকৃত ভালোবাসা। আসলেই তাই। প্রেম-ভালোবাসায় লুকোচুরি থাকতে হয়, অভিনয়-অভিসারের আকুলতা প্রেমকে মজবুত করে, শক্তি জোগায়, প্রেরণা দেয়।
শব্দফুলের সমাহারে গ্রন্থিত অনবদ্য সৃষ্টি কাননবালার নাম কবিতা। তাই কাব্যকাননের কারিগর হচ্ছেন একজন কবি। কবিতার সমষ্টিগত নাম কাব্য। কবিতায় থাকে আচ্ছন্ন আবেশ, থাকে ধোঁয়াশা, কিছু অস্পষ্টতা। কবি সরাসরি কিছু বলেন না, ইনিয়েবিনিয়ে ভাব বিনিময় করাই কবির কবিত্ব। কবিতায় অলংকার, উপমা, উৎপ্রেক্ষার উপস্থিতি যত বেশি থাকবে কবিতার সাহিত্যিক মান ততই বৃদ্ধি পাবে। মাওলা প্রিন্স একজন কবি, কবিতা ফুলের কারিগর তিনি। তার লেখায় এসবের সরব উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। তার রচিত “দিবারাত্রি প্রেমকাব্য” বইটি পুরোপুরি পড়ে যতসামান্য আলোচনা করার অভিপ্রায় রয়েছে আলোচ্য লেখায়। রাশেদ সুখনের প্রচ্ছদে মলাটবদ্ধ কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তে। ইতোমধ্যে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় সংস্করণও বেরিয়েছে। স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তদুয়ার’ প্রকাশ করেছে মাওলা প্রিন্সের কাব্যগ্রন্থটি।
একজন কবি সমাজকে দেখেন নিজের মতো করে, একান্ত নিজের অনুভূতি দিয়ে। তাই কবির চোখকে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে যাবে সমাজ সংস্কৃতি তা ভাবা কঠিন। সমকালীন প্রেক্ষাপটের প্রতিও কবিদের চোখ বেশ তীক্ষ্ণ। নিরীক্ষার আলোকে কবি দায়িত্বশীল ভুমিকা রাখেন সবসময়ই। বর্তমানে প্রেম-ভালোবাসার নামে যা হচ্ছে সচেতন কবি হিসেবে মাওলা প্রিন্স তা অন্তর্দৃষ্টির স্কেচে আঁকতে চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করেই। দেহজ প্রেমের প্রলোভনে আসক্ত না হয়ে তিনি ভালোবাসার আকুতি উচ্চারণ করেন এভাবে :
কর্ষণ করবো— বুকে স্থান চাইলাম— বললে, ‘ওখানে অনেক ব্যথা—’
ঘর্ষণ সইবো¾ পায়ে স্থান চাইলাম¾ বললে, ‘তোমার এ-কী কথা¾’
হাতে হাত দুটো চাইলাম¾ দীর্ঘশ্বাস ফেললে, ‘দেখো-না হস্তরেখা¾’
মদমত্ত মাতালের মতো উন্মাদ আমি হাত বাড়ালাম তোমার দিকে
হাত আমার আসেনি ফিরে¾ তুমিও দাওনি ভরে¾
কোথা থেকে এলো একজোড়া পালক-পাতা!
কবি ভালোবাসার হাহাকারে নিমজ্জমান থাকলেও প্রকৃত মানবিক প্রেম না পাওয়ার আকুতি তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কবি পিছনে ফিরে যান, পথ হাঁটেন, গর্জন শোনেন, রাত দিন নিথর হয়ে থাকেন, কেঁপে কেঁপে কেঁদে কেঁদে অশ্রুপাতে প্রেমের গীত রচনা করেন। কবির প্রেয়সী আসেন, হাসেন, হৃদয় ক্যানভাসে ভাসেন, জল নিবারণ চুমুকে সকল দুঃখ ব্যথা নাশেন। তবুও কবির প্রেম যেন ধোঁয়াশার কোপানলে বিয়োগ ব্যথার সৃষ্টি করে। কবি হতবিহ্বল হয়ে আকুতি বোনেন আবারও এভাবে :
হাসির ছলনায় বিয়োগ বেদনায় হিসাব মেলানো দায়;
বিফল কিংবা সফল¾ অজানাই থেকে যায়।
কবির মন গগনশিরীষ বন, বুকের ভেতর মোমের পুতুল সমেত অন্তরজ্বালা, মিলিত হওয়ার অভিলাষ নেই, পূর্ণতার আশা নেই, চুম্বনে হৃদয়ের আকুতি নেই, আছে বিরহ-বেদনায় চির অক্ষয় হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়। কবি প্রেমানলে পুড়ে খাঁটি স্বর্ণ হতে চান। চিলেকোঠায় কথার ফুলঝুরি নেই, আছে পদ্য-গদ্যের যুগল আলিঙ্গন। আঁখিতে অশ্রুপাত আছে, ব্যথা-বিচ্ছেদ, ক্লেদ আছে, চোখে জল, ছল, তবুও আশ্বাসবাণী এ প্রেম যেন মিছে কিছু নয়।
কবি পথ চলেন, রথ চালান, ভুল করে হাত বাড়ান, অনিদ্রায় রাত জাগেন, উচ্ছ্বাসে দুচোখ ভাসান, পালিয়ে বেড়ান, প্রেয়সীকে কাঁদান, হাসান, হারান। কবির চোখে সবকিছু সসীম হলেও অসীম শুধু প্রেম, ভালোবাসা। কবির চোখে জলরঙের প্রেম যেভাবে ধরা দেয় :
নীল কিংবা বেগুনি লাল কিংবা সবুজ সব মিলেমিশে একাকার
আঁখিজলে জলরঙে।
কবি প্রেমের রঙ মেখে হৃদয়ের আবিলতা ঝেড়ে ফেলে বাহুডোরের অভিসারে এগুতে চান। উচ্ছ্বাস, উল্লাস, উদ্ভাস, শঙ্খঝিনুকের চাষ, এসব কবির কল্পনা, আকুলতা। কবি সাজগোজে বদল আনেন। মিষ্টি রঙের কামিজ, কালো পাজামা, জর্জেটের কালো ওড়না, কালো চটি, ঘন কালো চুল, কালো টিপ এসব মনোলোভা দৃষ্টিনন্দন অবয়বে কবির মেঘবালিকা এখন স্বপ্নসারথি। কিন্তু আবারও কিসের যেন ভয়, আশংকা, হতাশা দুর্ভাবনা কবিকে হতবিহ্বল করে তোলে। না পাওয়ার, না ছোঁয়ার, আঁধারের বাধা ঠেলে ফিরে আসার পরেও না বলার আকুতি এমনই :
নারাঙ্গি বনে সবুজ পাতা কাঁপে¾
নারাঙ্গি বনে সবুজ পাতা কাঁপে¾
হৃদয়ে আমার সাত সাগরের ঝড়¾
হাওয়ার হাওয়ায় পালগুলো সব ফাঁপে¾
মেঘবালিকার ক্ষণকালের মিলন বিয়োগ ব্যথার আর্তনাদের প্রতিধ্বনিতে চৌচির হয় চারদিক। দহন-কথনের অভিব্যক্তি আড়ষ্ট করে কবিমন। হৃদয়জমিনে সাহারা সমেত মরু-উদ্যান।
উত্তাল সাগর, ঊর্মি-বাঁধন, পুষ্প বৃষ্টি, কাকলি মিষ্টি, পরাজিত তমস্বিনী, বৃষ্টির মাঝে কুমারী বালি, বুনো শেফালিকা, অভিসারে অনামিকা, জলতরঙ্গের কুমারী চঞ্চল চির চলন্তিকা প্রেয়সীকে হারাতে চান না কবি। রূপোর কারুকাজ, জলদেবী সমেত লজ্জাবতী লাজুকলতার মেঘবালিকাকে কবি ডাকেন :
শোন রে সখা শোন¾ মন আমার গগনশিরীষ বন;
বুকের ভেতর মোমের পুতুল¾ দিবারাত্রি চলছে ক্ষরণ।
সুখের প্রদীপ নিভে যায়, মিলনের হাহাকারে বিষাদ বিলাপের খাঁ খাঁ প্রান্তরে ধূসর মরুভূমির হাতছানি। তাই কবি প্রেয়সীকে বনের পাখির সাথে তুলনা করে বলেন :
জানি বনের পাখি মানে না পোষ¾ করে না আপোষ¾ শুধু শুধু হয়রানি
জানি দুজনার হবে না কথন¾ হবে না মিলন¾ শুধু শুধু কাতরানি
এতো কিছুর পরও কবি মানসলোকে প্রিয়ার ছবি আঁকেন, হৃদয় ক্যানভাসে জাগরূক রেখে চলেন প্রভাত রবি করে। সাদা মেঘ, মেঘের খেলা, মেঘের চুম, বুনোপাখির ধুম, বাসন্তীকার উড়াউড়ি, নীলাকাশের স্বপ্নঘুড়ি, স্মৃতি দিবসের প্রচ্ছদমুখ, হৃদয়দোলা চন্দ্র আভা, বন, পথ মাড়িয়ে, দুকূল ছাপিয়ে, প্রণামে বকুল ক্রন্দনে ব্যথাতুর ধ্বনি যেন কবির মনোলোকে বেহুলার সুর তোলে। কবি অবলীলায় বলে যান এভাবে :
কান পেতে শুনি¾ দূরে বাজে ধ্বনি¾ বাজে ঐ বেহুলার সুর।
কে রে তিয়াসি¾ প্রেম পিয়াসি¾ তোরও প্রিয়া বহুদূর।।
প্রিয়ার কাছে এসে, পাশে বসে, মায়াবী চোখে প্রেমগাঁথার আকুতি শুনতে পাননি কবি। ভয়, উপেক্ষা, অভিগমন, বিচ্ছেদ, বিসর্জন আতংকে কবি এখন মুসাফির। এখন যাযাবর। অকারণ ভালোবাসার সাধ, অভিমান, আঁখি মোছা, হৃদয়ের ব্যথাভারে ফুলমালাও হেলে পড়ে যেন দিবালোকে।
শৈশবের কোলাহল ফেলে কৈশোরের পদভারে, সোনালি প্রহরে, বাসন্তী কোকিলের কুহুতানে, রংধনু লগনে ভালোবাসার জয়ধ্বনি কবিমানসে তোলপাড় তোলে। কখনো আবার নয়নাকাশে হাজারো নাক্ষত্রিক আলোক আভা, রূপালি জ্যোৎস্নাধারার পুলকসঞ্চার স্রোতহীন মরা গাঙের মতো শূন্যতার নীরবতার আচ্ছন্ন আবেশ তৈরি করে। তাই কবির আকুতি :
আজ হৃদয় হয়েছে মরা গাঙ
সখি, আজ হৃদয় হয়েছে মরা গাঙ
তাই ভালোবাসা চাই¾
আরো ভালোবাসা¾
শুধু ভালোবাসা¾
এই যাতনা বিষে কবি ছন্দ ভুলে যান, বোঝেন না ব্যাকরণ। দিবারাত্রি সখার দোলনে মথিত হতে থাকেন বারবার, হাজারবার, বহুবার।
প্রেমে হার বলে কিছু স্বীকার করেন না কবি। রাধা-কৃষ্ণ, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জোলেখা, সেলিম-আনারকলি, কিংবা বুদ্ধ-সুজাতারা কোন যুগ বা কালের মানুষ নয়, দাবি করেন কবি মাওলা প্রিন্স। কবির চোখে তাদের প্রাত্যহিক পথচলা কিংবা যুগমানস এক না হলেও তারা এক হয়েছেন, এক জায়গায় এসেছেন ভালোবাসার দাবিতে। তাই কবির দৃষ্টিতে প্রেম মানে আত্মসমর্পণ, আত্মবিসর্জন, হাতে হাতে পাওয়া নয়, এ যেন প্রাপ্তির আয়োজন। সুখের সমারোহ।
সদ্য পরিচয়, মননে বিজয়, প্রেয়সী শশী, সুন্দরী, মায়াবী এক মনোলোক ভালোবাসা। যেখানে ন্যায়-অন্যায় আপেক্ষিক। যেখানে দুজনকেই কাঁদতে হয়। আহত কবি পাখির অবুঝ মনের দাবি :
ওই তো আমার পুরস্কার¾ ওই তো আমার পুণ্যফল¾
তুমি আমি মিথ্যে হলেও সত্য হোক অশ্রুজল¾
তাই জীবনে কী হলো বা হলো না, খল নাকি ছল, ভয় নাকি ক্ষয়, সুখের মাখামাখি নাকি আঁখিজলের কাঁদাকাটি, ছেদ-বিচ্ছেদ নাকি কাছে টানাটানি, এ নিয়ে কবির মাথাব্যথা নেই। পিরিতিতে হাসতে হাসতে কাঁদতে জানার নাম প্রেম, ভালোবাসা। তাই তো কবি আক্ষেপ করেন, তিনি চণ্ডীদাসের ভাষায় বলেন :
সই, কে বলে পিরিতি ভালো¾
হাসিতে হাসিতে পিরিতি করিয়া¾ কান্দিতে জনম গেলো¾
কবি তাই কাঁদতে চান না আর। তাতে কেউ স্বার্থপর ভাবলেও কবির আপত্তি নেই কোনও। সুখগুলো সমভাবে ভাগ করে নেয়াই কবির অঙ্গীকার, কবির ভালোবাসা, জীবনের প্রণয়।
সাহস, আবেগ, রঙ, ঢঙ, নীল, সবুজ, হলুদ, রঙিন, প্রদীপ শিখা, আলো-আঁধারের খেলা মানেই প্রেম। ভীরুতা, পলাতক মানসিকতা ও কাপুরষতা একজন প্রেমিকের আদর্শ নয়। অমরত্বে বাঁচতে হলে পালিয়ে নয় শত বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে, অনির্বাণ দ্যুতি ছড়িয়ে, মৃত্যু দ্বার উন্মোচিত করে পূর্ণ জোয়ারে জীবনের জয়গান গেয়ে যান প্রেমমানস কবি। মাওলা প্রিন্সের ভাষায় :
ভাঙ রে আজি মৃত্যু দ্বার¾ কেটে যাক মৃত্যু আঁধার¾
ধেয়ে আসুক পূর্ণ জোয়ার¾
জীবনের জয়গান ;
জীবনবিলাসী তাই¾ বারংবার ফিরে পাই¾
জীবনের গতি¾ জীবনের রঙ¾ অফুরান।
প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ককে কবি অজগর, আম এবং শিশু আমির মাঝে দ্বান্দ্বিক সম্বন্ধের মেলবন্ধন এঁকেছেন চমৎকার উপমায়, অসাধারণ ঢঙে। শুধু বর্ণ পরিচয় পর্বে নয়, চির দিনের এই দ্বান্দ্বিকতার কোলাহলেও মানুষ জয়ী হয়, প্রেমের জয় হয়। এজন্য কবি আমাদেরকে আগে মানুষ হতে বলেছেন, মানুষ হওয়ার তাগাদা দিয়েছেন। উপমা টানতে গিয়ে অভিযোগের সুরে কবি বলেন :
স্বর্গের দেব-দেবীরা হিংসা-দ্বেষ-কুটিলতা-শঠতা-পক্ষপাতিত্বের আশ্রয় নেন
মৃতপ্রায় ঈশ্বর জেনে-শুনে-বুঝেও নিশ্চুপ থাকেন
ধর্মযুদ্ধের নামে চলে শক্তি প্রদর্শন
সূক্ষ্ম কিংবা স্থুল কারচুপিকে প্রচার করা হয় ‘লীলা’ সম্বোধনে
তারপরও তো জয়ী হয় মানুষ¾
জয়মাল্য ওঠে রাবণ-মেঘনাদ-একিলিসের গলায়।
কবি মানবপ্রেমে জয়ী হওয়ার মানসে নিয়তিকে অতিক্রম করে, বিধিকে অবরুদ্ধ রেখে জীবনসত্যে অমরত্বের মালা পড়তে চান। এজন্য কবি ঝিনুক কুড়াবেন, কথার ফুলঝুরিতে হারিয়ে যাবেন, আবারও ভালোবাসার নোঙর ফেলবেন শিগগিরই। তাইতো কবির উচ্চারণ :
জানি, যে যায় সে ভাঁটার পথিক¾ ফিরে আসা মানেই জীবন¾
ফিরে সে আসবে¾ ফিরে আসতেই হবে¾ বৃথা হবে না এ ক্রন্দন।
কবিরা নিজেরা যেমন স্বপ্ন দেখেন তেমনি স্বপ্ন দেখান জাতিকে। এজন্যই সকল বিয়োগব্যথা মাড়িয়ে দিন শেষে মধুর মিলনের প্রত্যাশায় আকুল হয়ে থাকেন কবি, কবিমন।
কবির অমিত প্রত্যয় বিশ্বাস, শুদ্ধ স্বচ্ছ সাবলীল নিঃসঙ্কোচ ফেরার দাবি, রাতের শেষে ঊষার আলো ঝলমলে সকাল সবই যেন প্রেয়সীকে বরণের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ। কী অসাধারণ আকুতি কবির! কী আবেগ¾ উচ্ছ্বাস¾ উদ্দীপনা! কবির ভাষায় :
তোলো, অশ্রুমুখী মুখটি তোলো¾
তোমার উজ্জ্বল কৃষ্ণশরীরে গাঢ় সবুজের আলপনা আঁকো¾
এখনো আমি মানে অপেক্ষা
তুমি অর্থ মুক্ত বিহঙ্গ
আঁখিজোড়া নরম আলোয় খুঁজে পাওয়া সবুজ সাঁকো।
কী অসাধারণ উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অলংকার! প্রেয়সীর এখনো মিলনের সময় হলো না। অথচ কবির সময় কাটে বৃষ্টির ধ্বনি শুনে, শিশিরের জল গুনে। একসময় বৃষ্টির ফোঁটা, শিশিরের জল বেড়ে উঠতে উঠতে ব্যথার পাহাড় গড়ে তোলে, ব্যথার সাগর বোনে। এতো কিছুর পরও কবি নিরাশ নন, হতাশ নন, বরং ফুলহারে অভিবাদনে মিলনের ক্ষণ গোনেন। তাইতো কবি সহাস্যবদনে বলতে পারেন :
ফুলহার রচি ভাই
বনে বনে ঘুরে বেড়াই
যেখানে যত ফুল
সৌন্দর্যে ছিলো অতুল
তুলে আনি সযতনে।
মালা গাঁথি আনমনে
স্বপ্ন বুনি ক্ষণে ক্ষণে
মালা ভরা মধু-সুখ
মনে জাগে প্রিয়-মুখ
পুজো দেই প্রিয়জনে।।
এখন ভোরবেলা। কবি তার প্রেয়সীকে ফিরে আসতে বলেন, নিঃসঙ্কোচে, নির্দ্বিধায়। সকল অভিমান ভুলে এলোকেশ ছেড়ে অশ্রুমুখ তুলে একবার ঠোঁটে হাসি মেখে চমক মায়াজাল বোনবার ঔৎসুক্য আহ্বান জানান।
কবির দৃষ্টিতে পৃথিবীর তাবৎ ধন-রত্ন, সবুজ-হলুদ-নীল-খয়েরীর মসৃণতা, বুনোফুল কিংবা গুল্মলতা পাতা, চক্রবাক-চক্রবাকীর ঝরাপালক, রাক্ষস-খোক্ষসের যমপুরী থেকে উদ্ধার পাওয়া রাজকুমার-রাজকুমারীর গল্প, কত তিরস্কারের অশ্রুপাত, ছেলেমানুষী, অহেতুক বাড়াবাড়ি, মিছেমিছি ভালোবাসাবাসির আকুলতা আজ দুজনের দুঃখবিলাস যেন। এজন্য কবি আগালেও প্রেয়সী পিছিয়ে যায়। এভাবেই টানাপোড়েনের আশঙ্কায়, প্রত্যাখ্যাত বা উপেক্ষায়ও দুজন দুজনের জন্য সকল ঘাত-প্রতিঘাত মাড়িয়ে স্রোতস্বিনী নদীর মতো প্রবল হয়ে এগুতে চান। এ আকুলতা কবিকে বলতে বাধ্য করে এভাবেই :
আমরা অপেক্ষা করি শুভ মুহূর্তের
আমরা স্বপ্ন বুনি সবুজ বৃক্ষের
আমরা কাব্য রচি মিলনের
অথচ ট্রাজেডিই আমাদের কাম্য।
কী অসাধারণ অসামান্য নস্টালজিক পারস্পরিক আকর্ষণ, অপ্রতিরোধ্য আবেগ, সংরক্ষিত অনুভূতি! তাইতো কবিই বলতে পারেন :
সে-সূত্রে যুগে যুগে তোমাকে চিনি
তবুও জানা আমার হয় না শেষ
যেমন শেষ হয় না গ্রহ-নক্ষত্রের শব্দহীন পথচলা প্রেয়সী প্রদক্ষিণে;
এতো মায়া, এতো সবুজে আঁকা, এতো সমূলে গাঁথা যার হৃদয়-মন, সেতো মোমের পুতুল হয়ে দিবারাত্রি আপন হয়ে থাকবেই। আবারও কেন যেন কবির গা ছমছম করে ওঠে, বুক হুহু করে কেঁপে কেঁপে কেঁদে ওঠে, প্রচণ্ড ঝড়ের পূর্বাভাস অনুভব করে, শব্দহীন গ্রহ-নক্ষত্রের ব্যথাভারে কেঁপে কেঁদে ওঠে হৃদয় জমিন, ভালোবাসার ভূখণ্ড-বসুন্ধরা। অনিষ্টের আশংকা উপলব্ধি করে কবি অস্ফুটস্বরে বলে যান :
আমি অনিষ্টের পূর্বাভাস পাই
আমি অশুভ প্রেতাত্মার পদধ্বনি শুনতে পাই
আমি প্রতিনিয়ত পাড় ভেঙে চলা প্রমত্ত নদের হুংকার শুনতে পাই
আর কতো কাল এভাবে বয়ে চলা যায়
একটা বোঝাপড়া প্রয়োজন
সরাসরি উত্তর চাই
‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ ¾
এজন্য কবি না বললেও সহ্য করতে চান, সহজ সাবলীল থাকতে চান, ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞ হতে চান। কিন্তু হ্যাঁ বা না এর মধ্যবর্তী স্থানে ঋষি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চান না তিনি। তাইতো কবি সরাসরি বলে দেন :
যেতে চাইলে ফিরবে না
থেকে থেকে কাঁদবে না
কাঁদবে যদি ফিরবে যদি যাওয়ার কথা বলবে না।
সখি, শশী, সুন্দরী, মায়াবী, মেঘবালিকা এখন কবির ভালোবাসার হৃদয়-জমিন। আকুলতার চারণভূমি, প্রশান্ত সবুজ মাঠ। অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করার গুল বাহার, পুস্পবন। কিন্তু ভয় হয়, আশংকা হয়। কবি যখন আবারও লিখে যান :
সখি, আর হবে না তোমার সনে
ভাঙলাম ঘর আপনজনে¾।
যতন করি গড়লাম যে ঘর
ভাঙলাম আজি অকারণে¾।।
এভাবেই কবি লিখে যান কবিতা। দিবারাত্রি প্রেমকাব্য। লিখতে লিখতে, পড়তে পড়তে একসময় কবি অশ্রুহীন হয়ে পরেন। কবির চোখের কান্না থেমে যায়। পিছন ফিরে তাকানোর আক্ষেপ শেষ হয়ে আসে। প্রচণ্ড ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে আসে, আজ কবিও তেমনি শান্ত-স্নিগ্ধ-নিরুত্তাপ-নিরুদ্বিগ্ন। একটা জগদ্দল পাথর যেন কবির বুক থেকে নেমে গেছে আজ। অজগরের সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ শেষে বিজয়ী বীর এখন কবি। তবুও কবি নির্বাক। নিরব নিথর নিস্তব্ধ যেন।
চাঁদের আলো আজ অনেক বেশি জ্বলজ্বল করছে, দিনপঞ্জি অনুসারে আজ নাকি দশমী। কবির সিদ্ধান্ত যাইহোক নির্ঘুম কাটানো রাতের সান্নিধ্যের ফলাফল বুঝি এভাবেই বলে গেলেন কবি :
সখি, তোর জন্যে ছাড়লাম ঘর¾
উদাসী হইলাম সংসারে¾
আমি একদিনও না চিনিলাম তোরে¾
নূতন করে¾ অশ্রু ঝরে¾ এসো না এসো না তুমি প্রেম¾ এতোটা কাল পরে।
কবির জীবনে প্রেম কখন কীভাবে এসেছিল নাকি আসেনি সেটা আজ বিবেচ্য নয়। সাহিত্যের আঙিনায় কাব্যটির একটা দখল থাকবে আশাবাদী। এমন একটি অসাধারণ দীর্ঘকবিতা উপহার দেয়ার জন্য কবিকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। সমালোচনার দৃষ্টিতে বলতে গেলে মনে হয়, কতেক কথোপকথনে কবিত্বকলার কাব্যিক মান ক্ষুন্ন হয়েছে। কবি আরো সচেতন হলে তা থেকে উত্তরণ পেতে পারতেন। এ অসচেতনতার দুর্বলতার সুযোগে মানের গতিতে শ্লথ উপস্থিতি কার্যকর হয়েছে। সে যাইহোক সবমিলিয়ে চমৎকার একটা কাব্যগ্রন্থ উপহার পেয়েছি আমরা, এটা নিসন্দেহে বলতে পারি। কবির আগামী পথচলা আরও শানিত হোক সেই কামনা রইল।
আর কথা নয়। যবনিকা টানতে হচ্ছে এখানেই। শেষ করতে চাই উক্তি দিয়ে, “যে হৃদয় ভরপুর প্রেমের আগুনে, তার প্রত্যেক কথাই হৃদয়ে ঝড় তোলে”। “প্রেম একটি জলন্ত সিগারেট, যার শুরুতে আগুন এবং শেষ পরিণতি ছাই”। কবি তার কাব্যিক দৃষ্টিকোণে কী বোঝাতে চেয়েছেন সেটা না হয় আলোচনার বাইরে থাক। তবে এটা প্রতীয়মাণ যে, দেহজ প্রেম নয় আত্মজ প্রেমের জয়গান গেয়েছেন মাওলা প্রিন্স। তাই ঈশ্বরের প্রেমের সাথে সাথে মানবপ্রেমের জয়গান গাওয়ার তাগিদ পাই কবিতার পরতে পরতে, পংক্তির ছন্দমালায়। প্রেমের জয় হোক। ভালোবাসার মাখামাখিতে পরিপূর্ণ হোক ধলো-কালো সকলের হৃদয়-মন। মানবজমিন।
Discussion about this post