চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-এর দ্বিতীয় উপন্যাস। ফ্রান্সের ‘আলপ্স’ পর্বত-ঘেরা অঞ্চলের ইউরিয়াজ নামক ছোট্ট একটি গ্রামে বসে সুদূর বাংলাদেশের গ্রাম্য যুবক ভীরু, লাজুক, দরিদ্র, পরাশ্রয়ী, প্রাইমারি স্কুলের অর্ধশিক্ষিত শিক্ষক আরেফ আলীর দ্বিধান্বিত-সংশয়ক্লিষ্ট অথচ বিশ্লেষণাত্মক মনোগহীনের গূঢ়ার্থ অনুধাবন এবং তার শব্দোচ্চারণের ব্যাপক প্রয়াস করেছেন তিনি উপন্যাসটিতে। এই যে চৈতন্যের গভীরে অবগাহন এবং সেখান থেকে সৃষ্ট ভাষা, সে ভাষার রূপায়ণ অবশ্যই ভিন্নতার দাবি রাখে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে যেমন আঙ্গিকগত নিরীক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, প্রচলিত ঐতিহ্যকে ভেঙে সামনে নিয়ে এসেছেন বিশেষ এক মনস্তাত্ত্বিক প্রবহমানতাকে, সেই অন্তর্গত অনির্বাণ মনের ভাব প্রকাশেও তেমনি তিনি সংশ্লিষ্ট থেকেছেন নিজস্ব গদ্যনির্মিতিতে সে নির্মাণ একই সঙ্গে নিবিষ্ট বিশেষ শব্দচয়নে, বাক্যবিন্যাসে, উপমা-প্রতীক-চিত্রকল্প সৃষ্টিতে, প্রবন্ধধর্মী-বিবৃতি-প্রধান ভাষার প্রকৌশলে এবং জীবনোপযোগী দার্শনিক তথ্য সঞ্চালনে। উপন্যাসের শুরু যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর অথই বিভ্রান্ত বিক্ষিপ্ত এক মানসিক অভিযাত্রার ভেতর দিয়ে। একদিন গভীর রাতে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে অযাচিতভাবেই জ্যোৎস্নাবিধৌত নির্জন বাঁশঝাড়ের ছায়াছন্ন নিবিড়তায় এক যুবতির লাশ দেখে ফেলে সে, এমন কি অনতিদূরে যেন হত্যাকারীকেও। আরেফ আলীর সেই মুহূর্তের চারপাশের প্রকৃতি-পরিবেশ-পরিস্থিতির বর্ণনায় তাই তারই অস্থির-উদ্ভান্ত মনোলোকের প্রতিচ্ছায়া :
ওপরে ঝলমলে জ্যোৎস্না কিন্তু সামনে নদী থেকে কুয়াশা উঠে আসছে। কুয়াশা না আর কিছু, হয়তো সে ঠিক বোঝে না। হয়তো একদল সাদা বকরী দেখে, যার শিং-দাঁত-চোখ কিছুই নাই। হয়তো মনে হয় রাত্রি গা-মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে বসেছে, চোখ-ধাঁধানো অন্তহীন জ্যোৎস্নালোকে জীবনের আভাস দেখা দিয়েছে। … শ্লথ গতি হলেও কুয়াশা সদাচঞ্চল। নড়ে-চড়ে, ঘন হয়, হাল্কা হয়। সুতরাং একসময়ে হঠাৎ চমকে উঠে উপরের দিকে তাকালে যুবক শিক্ষকের শীর্ণমুখে একঝলক রুপালি আলো পড়ে। স্বচ্ছ-পরিষ্কার আকাশে কুয়াশা মুক্ত চাঁদ আবার ঝলমল করে। স্নিগ্ধ প্রশান্ত চাঁদের মুখ দেখে অকারণে সভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে আবার ছুটতে শুরু করে। ওপরে চাঁদ হেলে-দোলে, হয়তো হাসেও। নির্দয় চাঁদের চোখ মস্ত। যুবক শিক্ষক প্রাণভয়ে ছোটে। … মাথা তুলে সে ধীরে-ধীরে এধার-ওধার তাকায়, বাঁ-দিকে, ডান-দিকে। কুয়াশা নাই। জ্যোৎস্না উদ্ভাসিত ধবধবে মাঠে কেউ নাই। দূরে একটা কুকুর বেদনার্ত কণ্ঠে আর্তনাদ করে। তাছাড়া চারধার নিঃশব্দ। একচোখা চাঁদ সহস্র চোখে জনশূন্য পথ প্রান্তর পর্যবেক্ষণ করে। চাঁদ নয় যেন সূর্য।
যুবক শিক্ষকের ভীতিতাড়িত মনোগহিন থেকে উঠে আসা উপলব্ধিতে পাল্টে গেছে চিরভ্যস্ত প্রাকৃতিক জগৎ তার বিচ্ছিন্ন একক অভিজ্ঞতায় প্রকৃতি এক ‘অদ্ভুত বিসদৃশ আকার’ ধারণ করেছে যেন। সেখানে জ্যোৎস্নার আলোয় সচল কুয়াশাঢাকা নদী, ক্রমে রূপ নিয়েছে একদল সাদা বকরীর রেখায়িত চিত্রের মতো ‘যার শিং-দাঁত-চোখ কিছুই নেই’। নদী সচল কারণতার ভীতি-আচ্ছন্ন চেতনায় কম্পমান জ্যোৎস্নার অন্তহীন আলো, প্রস্ফুটমান জীবনের মতোই যার ক্রমবিস্তার। যেন সজীব সবাই নদী, কুয়াশা, রাত্রি। তার ভারসাম্যহীন হোঁচট খাওয়া ছুটন্ত দেহের সমান্তরালে ‘হেলে-দোলে’ রাতের চাঁদ, যার অকুণ্ঠিত আলোর জোয়ারে ভেসে যায় প্রান্তর, মাঠ, তাতে ঘুচে যায় যত অপ্রকাশ্যের আড়াল। পলায়নপর যুবক শিক্ষকের চেতনায় ‘এক চোখা চাঁদ সহস্র চোখের’ পর্যবেক্ষণকারীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এখানে বর্ণনার ভঙ্গি অসরল, ভঙুর। উপমা, চিত্রকল্পের ব্যবহারও তাৎপর্যবাহী যুবক শিক্ষকের মনের ঘূর্ণাবর্তে বদলে গেছে উপমান এবং চিত্রকল্পের পরিভাষা। আবার একটি বিশেষ দ্ব্যর্থবোধকতা অর্থাৎ ‘আয়রনি’-এর সন্ধাবও মেলে উপর্যুক্ত বর্ণনাটি থেকে হত্যাকারী দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠতে চায় তার সামনে বারংবার, অথচ সে চায় অপরিজ্ঞাতের আড়াল। এ যেন অনতিবিলম্বে যুবক শিক্ষকের মনোগহীনে ঘটতে চলা সেই জটিল বিভ্রান্তিরই পূর্বাভাস।
যে বড়বাড়ির আশ্রিত আরেফ আলী, সে বাড়িরই একজন সদস্য হত্যাকারী কাদের মিঞা বড়বাড়ির প্রধান পুরুষ দাদাসাহেবের কনিষ্ঠ ভাই। দাদাসাহেবের ভাষায় দরবেশ সে, রাত-বিরেতে ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। তাই কাদেরকে হত্যাকারী ভাবতেও পরিশ্রান্ত হয় যুবক শিক্ষকের মন। অনবরত আত্মতদন্ত চলতে থাকে তার মনোগহ্বরে। ইতিমধ্যে কাদেরের অন্যায় আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুক্ত হয়ে যায় সে আরেক নিরীহ অপরাধে বাঁশঝাড়ে পড়ে-থাকা যুবতির মৃতদেহ নদীবক্ষে নিক্ষেপে তার সহায়তা নেয় কাদের। অন্তরাবেগে আচ্ছন্ন আরেফের সে-মুহূর্তের মানসবর্ণনায় ভাষা আশ্চর্য সংযত, অথচ চৈতন্যের অতল ধারার মতো ফল্গুবাহী। তার মন এবং দেহ বিচ্ছিন্ন যেন সেখানে দেহ ক্রিয়াশীল কিন্তু মন অসহনীয় পীড়নে নিঃশেষে পিষ্ট :
শীঘ্র যুবক শিক্ষক নিঃসঙ্গ বোধ করতে শুরু করে একটা নিদারুণ বেদনায় বার-বার ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। অকারণেই যেন কতগুলি অর্থহীন ঘরোয়া চিত্র তার মনের পর্দার ওপর দিয়ে ভেসে যায়। তার গ্রামের মুদির দোকানের ফেনি বাতাসা, ঘরের পেছনে শেওলাপড়া ছায়াছন্ন পুকুর, পড়শির নুতন বেড়া। তার বর্তমান যাত্রার পরিণাম তার কাছে প্রত্যক্ষ-গোচর হয় না বলে হয়তো তার ভীত মন পশ্চাতের পরিচিত স্থানে খুঁটি গাড়তে চায়। … তারপর বাঁশঝাড়ে সে কাদেরকে সাহায্য করে, কিন্তু কিছু না দেখে কিছু না অনুভব করে। সময় দীর্ঘ ঢেউ-এর মত ধীরে-ধীরে বয়ে যায়, চোখের অন্ধকার আরো নিবিড় কালো হয়, তার সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয় শিল-পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে থাকে। … একবার কাদেরের কণ্ঠস্বর তার কর্ণগোচর হয়। অনুচ্চকণ্ঠ, তবু সন্দেহ থাকে না যে যুবক শিক্ষককে সে তিরস্কার করে। “শক্ত করে ধরেন না কেন?” সে বলে। কীসে শক্ত করে ধরবে? তার হাতে দুই খণ্ড হিম শীতল কাঠ। কিন্তু নিজের হাত দুটিও কাঠের মত প্রাণহীন মনে হয় তার কাছে। … আবার কাদেরের গলা কোত্থেকে ভেসে ওঠে। তখন কালোস্রোতে যুবক শিক্ষক ভাসছে। কাদেরের কণ্ঠ অনেক দূরে অজানা কোন পানির জন্তুর মত লাফিয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষক হিমশীতল কাঠদুটি প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে। … নিচে নেবে যুবক শিক্ষক এবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চাপা স্বরে কাদের আবার ভৎর্সনা করলে সে উঠবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। দেহে একবিন্দু শক্তি আর নাই। হাড়-মাংস গলে নিঃশেষ হয়ে গেছে! … কিছুক্ষণ পরে একাকী কাজ শেষ করে কাদের যখন নিঃশব্দে তারপাশে এসে দাঁড়ায়, তখন তার কিছু সম্বিত ফিরেছে। … কোমর পর্যন্ত তার (কাদেরের) কাপড় ভিজে জবজব করছে। সে তার দিকে তাকিয়ে আছে বলে তার মুখটা অন্ধকারে ঢাকা। তারপর অস্পষ্টভাবে তার চোখ সে দেখতে পায়। সে-চোখে যেন পরম ঘৃণার ভাব। কাদেরের পায়ের তলে সে যেন ঘৃণ্যবস্তু, শিড়দাঁড়াহীন নপুংশক কীটপতঙ্গ কিছু।
এমনিতর একটি অনভিপ্রেত অনাকাঙ্ক্ষিত কাজের সহযোগী হতে চায় নি আরেফ। তার বিপন্ন-অপাপবিদ্ধ চেতনা অপরাধের আত্মগ্লানি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে প্রতিক্ষণে। কিন্তু দুর্বল সে, অপারগতার দুঃসহ যন্ত্রণায় ঘৃণাবোধ করেছে সে নিজের প্রতি। সেই ঘৃণারই প্রতিচ্ছায়া দেখতে পায় সে কাদেরের চোখে। তার নিস্পিষ্ট মন অসহনীয়তার দুর্ভারে দলিত-গলিত পড়ে থাকে তাই কাদেরের পায়ের নীচে, ‘শিরদাঁড়াহীন নপুংশক কীটপতঙ্গে’র মতো।
জীবন সদর্থক, ‘বাস্তব জীবনে মানুষ মানুষের প্রতি এমন নির্দয় নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন নয়।’ এমনি এক মোহময় বিশ্বাসেই স্থিরতা আসে আরেফের মনে, ঢুকতে চায় সে কাদেরের মনোগহ্বরে কেননা ‘কাদেরকে না বুঝতে পারলে বিচিত্র অভিজ্ঞতাটির রহস্যমোচন হবে না। ‘কিন্তু কাদেরকে অনুধাবনের যোগ্যতা কী সে রাখে? অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলে সে নিজেই নিজেকে। কাঠগড়ার আসামীর মতো সত্য-মিথ্যার গোলোকধাঁধায় কুণ্ডলীকৃত হয় তার অন্তর :
ক্ষণকালের জন্যে একটি অজানা অন্তর্বেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যুবক শিক্ষক। সে-ভাবাবেগ কাটলে সে গভীর নিঃসহায়তার সঙ্গে ভাবে, সে অল্পবয়সী দরিদ্র শিক্ষক, বাঁশঝাড়ে নিহত মানুষের মৃতদেহ কখনো দেখে নাই। তার যে মস্তিষ্ক-বিভ্রান্তি ঘটবে তাতে বিস্ময় কী? সে কিছুই বোঝে না, কিছুই জানে না? চতুর্দিকে যে অন্তহীন রহস্য সে অনুভব করে তার কতটা সে বোঝে? সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, উদ্ভিদ-তরুলতা, নদীপ্রবাহ, মানুষের হাসিকান্না-দুঃখকষ্ট তার জন্মমৃত্যু: এ-সবের অর্থ কী সে বোঝে? … কাদের যে হত্যাকারী সে-ধারণা কী করে যায়? যে ধারণা তাকে ভীত-নিপীড়িত করেছে, সে-ধারণা থেকে কোন্ যুক্তি-সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে সে মুক্তি লাভ করে? … এ প্রশ্নের কী কোন বোধগম্য উত্তর আছে? সবই বিশ্বাস। দোষী, সেটাও বিশ্বাস; নির্দোষ সেটাও বিশ্বাস। বিশ্বাসের ওপরই কী সমগ্র মানবজীবন নির্ভর করে নাই?
আরেফ আলীর সে বিশ্বাসেও ধ্বস নামে যখন হত্যাকারী নিজেই স্পষ্টতায় ধরা দেয় তার কাছে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, “আপনি জানতেন না?” কাদেরের স্বীকারোক্তি নতুন করে মোড় ফেরায় যুবক শিক্ষকের মনের গতির। ‘হত্যা’টিকে ‘দুর্ঘটনা’য় প্রমাণ করতে তার অদৃশ্য মন মেতে ওঠে যুক্তি, বিশ্লেষণ আর অনুসন্ধানের নতুন উদ্দীপনায় :
আজ সকালে কাদের স্বীকার করেছে, সে-ই যুবতি নারীর হত্যাকারী। তবে সেটি ঠিক হত্যা নয়, একটি দুর্ঘটনা। বাঁশঝাড়ের বাইরে যুবক শিক্ষকের পদধ্বনি এবং পরে তার গলার শব্দ শুনতে পেলে হঠাৎ ভয়ে দিশাহারা হয়ে সে যুবতি নারীর গলা টিপে ধরেছিল। হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, তার মুখের আওয়াজ বন্ধ করার জন্যে। … তাহলে যুবতি নারীর দেহটি নদীতে ফেলার ব্যাপারে কাদের যুবক শিক্ষকের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিলো কেন? কথাটির কোন ব্যাখ্যা কাদের দেয় নাই। … এখন বিষয়টির ব্যাখ্যা শিক্ষকের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে হয়। চারটি সম্ভাব্য উত্তর তার দৃষ্টিগোচর হয়। এক বাঁশঝাড়ের ঘটনার পর কাদেরের মনে নিশ্চয়ই গভীর বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। হয়তো একটি ঘোরতর পাপ-বোধে সে জর্জরিত হয়ে পড়ে। … দুই তার এই বিশ্বাস হয় যে, যুবতি নারীর মৃত্যুর সঙ্গে যুবক শিক্ষক জড়িত, কারণ বাঁশঝাড়ে সে উপস্থিত না হলে দুর্ঘটনাটি ঘটতো না। অতএব দেহ-বহন কার্যে সাহায্য করা তার কর্তব্য। … তিন যুবতি নারীর মৃত্যুর কথা যুবক শিক্ষক ছাড়া অন্যকেউ জানে না। দেহটির বহনকার্যে তার কাছ থেকে একবার সাহায্য আদায় করতে পারলে তার মুখ বন্ধ করা সহজ হবে। … চার ভয়াবহ কাজটি একা করতে সাহস পায় নাই। যুবক শিক্ষকের অগোচরে দেহটি একবার অদৃশ্য হয়ে গেলে সে কোন অভিযোগ আনলেও সাক্ষীর অভাবে তা প্রমাণ করতে পারবে না।
লক্ষণীয় যুবক শিক্ষকের অন্তর্বিশ্লেষণে ভাষা এক্ষেত্রে এক ধরনের প্রবন্ধসুলভ যুক্তিনির্ভর, একইসঙ্গে সংখ্যা ক্রমের বিন্যস্ততায় বিবৃতিমূলক রূপ লাভ করেছে। চরিত্রের অন্তর্যামী থেকে প্রাবন্ধিক গদ্যরীতির এমন আবেগরহিত সংহত ভাষার সৃষ্টি ঔপন্যাসিকেরই বিশেষ শিল্পকুশলতা। এই কুশলতায় বরাবর নিরীক্ষণীয় থেকেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। যেমন একের পর এক যুবক শিক্ষকের দ্বন্দ্বসংকুল মানস-উন্মোচনে দার্শনিক তত্ত্ব এবং তথ্যের সঞ্চালন ঘটিয়ে প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন যে, মনের নিগূঢ় ভাব প্রকাশে দার্শনিকতাও ভাষার লাবণ্য ধারণে সক্ষম :
জীবনের মূল্য কী কেউ কখনো সঠিকভাবে বুঝতে পারে? মানুষ সর্বদা, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, জীবনের মূল্য নিরূপণ করার চেষ্টা করে কিন্তু সক্ষম হয় কী? কী দিয়ে ওজন করে তুলনা করে? স্বর্ণকারের নিক্তিতেও তার মূল্য যাচাই করা যায় না। তার মূল্য নিরূপণের কোন মানদণ্ড নাই। … মানুষের ভাগ্য খামখেয়ালী এবং নির্মম হলেও মানুষ মায়া-মমতাশূন্য নয়, অতি নিস্পৃহের নিকটও অন্যের জীবন মূল্যহীন নয়। … জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস মানুষের সহানুভূতি, সহৃদয়তা, স্নেহমমতা। সে-বিষয়ে নিশ্চিত হলেই মানুষ বিভীষিকা-নিষ্ঠুরতার দিকে নির্ভয়ে তাকাতে পারে। … অপরাধের গুরুত্ব অপরাধের ফলের ওপরই নির্ভর করে না। … অকস্মাৎ ভয় হলে বুদ্ধি-বিবেচনা শক্তি হারিয়ে একটি মানুষ অন্য একটি মানুষের জীবন নিতে পারে। জীবন অতি ভঙ্গুর! জীবন দুর্বল সুতায় বাঁধা। সামান্য অসাবধানতায় জীবনাবসান হতে পারে। … অন্ধবিশ্বাস দাবী করে দৃষ্টিশক্তি আশা করা অনুচিত। কিন্তু যে-ক্ষুদ্র জগতে মানুষ বিচরণ করে সে-জগতের কোথায় ভালো কোথায় খারাপ সে-কথা বিচার করার ক্ষমতা মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া উচিত নয়। সে-ক্ষমতাটুকু হারালে মানুষ অতিশয় সীমাবদ্ধ প্রাণীতে পরিণত হবে।
বাস্তব এই জীবনদর্শনই জাগ্রত করে আরেফের কর্তব্যপরায়ণতা; কিন্তু দাদাসাহেব অবধি পৌঁছেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসে সে, আচ্ছন্ন হয় নতুন এক ভাবাবেগে কল্পনার জগৎ ঘেটে উদ্ধার করে সে কাদেরের প্রেমিক হৃদয়, অতঃপর প্রতিস্থাপিত করে তা মনের দর্পণে :
কাদের বলেছিলো, আশ্বিন মাস। হয়তো আশ্বিনের প্রথমাংশ, ভাপসা গরমটা তখনও কাটে নাই। নদীতে ভরা যৌবন, খাল-বিল-পুকুরও কানায়-কানায় ভরা। ছায়াশীতল পুকুরটির একটি পাড় কেমন উঁচু, যেন উদ্ধতভাবে ঘাড় তুলে দাঁড়িয়ে। সেখানে বসে কাদের। সামনে তেল-চকচকে মসৃণ ছিপ, অদূরে শান্ত পানিতে ফাত্নাটি স্থির হয়ে আছে। … থেকে থেকে কেমন একদৃষ্টিতে পুকুরের অন্যদিকে সে তাকায়। সেখানে একটি যুবতি নারীদেহ-নিমজ্জিত করে অলসভাবে পানির শীতলতা উপভোগ করে। তার সিক্ত কালো চুলে প্রথম সূর্যের প্রতিফলন, পাশে একটা লাল রঙের আঁচল ভাসে। …
শুধু এই একটি চিত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না যুবক শিক্ষকের মন। কাদেরের মতো যুবতি নারীর সরল দৃষ্টিতেও ‘কেমন সলজ্জিত আকাঙ্ক্ষার আভাস’ দেখতে পায় সে। ব্যাকুল কাদের হৃদয়ের গোপন কথাটি ব্যক্ত করার জন্যই সেদিন বাঁশঝাড়ে ঘনিষ্ট হয়েছিল অনুপস্থিত মাঝির সেই যুবতি-বৌয়ের। তাই সামাজিক নিষেধাজ্ঞার ফল-ভোগ করতে হয়েছে তাকে সাথে সাথেই, আপন হাতে হত্যা করতে হয়েছে প্রেমিকাকে। হয়তো এজন্য অনুতপ্তও সে ‘অন্যায় হোক, তবু যুবতি নারীর প্রতি কাদেরের মনে মায়া মমতা ভাবাবেগ ছিলো। বাঁশঝাড়ের দুর্ঘটনাটি তাই নির্দয় নির্মম হত্যাকাণ্ড নয়। ‘কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না আর, আরেফের করা প্রশ্নের উত্তরে কাদেরের বিহ্বল নীরবতাই প্রমাণ করে দেয় কোন ব্যর্থ মরীচীকার পিছু অকারণে ছুটে চলেছে সে। তার সে মুহূর্তের ভূ-পতিত-নিঃশেষিত-বিধ্বস্ত অন্তঃকরণের নিপুণ শব্দোচ্চারণ একজন মনোবাস্তববাদী লেখকের ভাষাবোধের উচ্চতাকেই স্পষ্টাকারে তুলে ধরে :
যুবক শিক্ষক বোধ করে, তার ভেতরটা হঠাৎ শীতল হয়ে উঠেছে। অধীর হয়ে সে বলে, “সত্যি কিনা বলেন। হাঁ-না কিছু বলেন।” কোন উত্তরই আসে না। তারপর যুবক শিক্ষকের মনে হয়, ক্ষুদ্র ঘরটা যেন চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে। সঙ্গে-সঙ্গে সেও ঘুরতে শুরু করে। তার মাথাটা শুন্য হয়ে ওঠে, তারপর দপদপ করে। একটা অকথ্য জ্বালায় সারা শরীরে যন্ত্রণাও জাগে। লোমশ বিষাক্ত বিচ্ছু গায়ে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে; হাতে, পায়ে। তারপর সমগ্র দেহে। কিন্তু সে কিছু পরওয়া করে না। তার দৃষ্টি কাদেরের প্রতি নিবদ্ধ। … তারপর যুবক শিক্ষকের মনে হয়, সে যেন দ্রুতভাবে কথা বলতে শুরু করেছে। গলা অনুচ্চ হলেও নিজেরই কানে তার স্বর অস্বভাবিক ঠেকে, বিষয়বস্তু ঠিক বোধগম্য হয় না। কেবল ক্ষিপ্র গতিতে অস্পষ্ট শব্দগুলি মুখ থেকে বেরিয়ে চতুর্দিকে ছিটকে পড়ে, একটার পর একটা, কোথাও জোড়া লাগে না, কোথাও বিদ্ধ হয় না। তাতে সে দমে না। শব্দগুলি সে ছুঁড়তেই থাকে, পাগল মানুষ যেমন ঢিল-পাথরের স্তূপ পেয়ে অশ্রান্তভাবে লক্ষ্যহীনভাবে তা ছুঁড়তে থাকে চতুর্দিকে। …
অবশেষে কাদেরের কণ্ঠ শোনা যায়, ঘৃণা এবং বিস্ময় নিয়ে যুবক শিক্ষককে সে ‘পাগল’ বলে অভিহিত করে, ভয়ও দেখায়। কিন্তু থামে না আরেফ, একাধিকবার বলা কথাটি আবার উচ্চারণ করে সে, “আমার কথাটা এখনো বুঝলেন না?” ‘একজন নিরাশায় ডুবতে থাকা মানুষ, কীভাবে শেষপর্যন্ত খড়-কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, শরীরের সমস্ত জোর একত্র করে উঠে দাঁড়ায় আবার, তাকায় সামনে উপবিষ্ট নির্বিকার এবং নিশ্চিত এক অপরাধীদের দিকে’ দৃশ্যটির বাস্তবসম্মত বর্ণনা অপসারিত এক্ষেত্রে, পাঠকের সামনে কেবল আরেফ আলীর নির্যাতিত, নিপীড়িত অবচেতনের প্রতিচ্ছায়া, তার নিষ্ঠুর নিয়তির অস্বাভাবিক মুখব্যাদান :
“আমার কথাটা এখনো বুঝলেন না?” কাদের কোন উত্তর দেয় না। যুবক শিক্ষকের প্রশ্নটি নিস্তব্ধ ঘরে কতক্ষণ বিসদৃশভাবে ঝুলে থাকে, তারপর প্রশ্নকারীকেই তা নির্মমভাবে লজ্জা দিতে শুরু করে। সেটি যেন তার প্রশ্ন নয়, তারই উলঙ্গ দেহ। সে-দেহ কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে।
অতঃপর আরেফ আলীর নিঃসহায় উচ্চারণ, “আমার আর কোন উপায় থাকলো না।” একইসঙ্গে তার শেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দাদাসাহেবের কাছে গমন।
শেষপর্যন্ত চাঁদের অমাবস্যা যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর পুনর্জন্মের ঘটনায় সম্প্রসারিত। যে নিদারুণ সংকটের মুখোমুখি সে, সেই সংকট থেকেই তার এই পুনর্জন্ম। অর্থাৎ আরেফের প্রতি মুহূর্তের দুঃসহ আত্মপীড়ন যেমন তাকে নিক্ষিপ্ত করেছে ‘ক্রম সংকুচিত নপুংসক কীটপতঙ্গসদৃশ তুচ্ছতায়’ তেমনি অপার সংকট আর আত্মগ্লানিই তাকে পৌঁছে দিয়েছে ‘জ্ঞানময়, দায়িত্বশীল ও স্বাধীন-ইচ্ছা জাগরিত এক শুদ্ধ সত্তায় (জঁ পল সার্ত্র অনুসৃত মতবাদ)।’ ভয়াবহ বিপজ্জনক সেই দায়বদ্ধতা পালনের পরিণাম সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েও অস্তিত্ব রক্ষায় দৃঢ়মূল থেকেছে সে। তবে শেষ সিদ্ধান্ত পালনে তার মানস যাত্রাটি কিন্তু তত সহজ ছিল না। তার সে-মুহূর্তের অন্তঃক্ষরণ পাঠকের জন্য আরেক বেদনাহত কুশলী উচ্চারণ :
দাদাসাহেবের খড়মের উচ্চ আওয়াজে উদ্বেগের আভাস নাই। হয়তো তাতেই সে অবশেষে আশ্বস্ত হয়, তার মনের আলোড়ন শান্ত হয়। তারপর দাদাসাহেব বারান্দায় উপস্থিত হলে সে সসম্মানে উঠে দাঁড়ায়, তিনি সশব্দে আসন-গ্রহণ করলে সে-ও আবার বসে। তারপর সে খোলা দরজা দিয়ে উঠানের দিকে তাকায়। সেখানে অস্পষ্ট ঈষৎ কুয়াশাচ্ছন্ন রোদ দেখা দিয়েছে। … দাদাসাহেব কাশেন। কোথায় সে শুরু করবে? নদীর উৎস কোথায়, কোথায়ই-বা জীবন-মৃত্যুর উৎপত্তি? তাছাড়া, জীবন কি সত্যিই মৃত্যুর চেয়ে অধিকতর মূল্যবান? দাদাসাহেব আবার কাশেন। তিনি অপেক্ষা করছেন সে-কথা যুবক শিক্ষককে জানান। যুবক শিক্ষক বোধ করে, তার ভেতর ঝরঝর করে কি যেন ঝরতে শুরু করেছে। তার অন্তর কি কাঁদতে শুরু করেছে একটি নিঃসহায় অজ্ঞানতার জন্যে? তারপর সে অস্পষ্ট গলায় বলে, “কাদের মিঞা একটি মেয়েলোককে খুন করেছে।” কথাটি বলার পরও তার ভেতরে সে-অজানা ধারাটি ঝরতে থাকে। ধারাটি ঝরতেই থাকে, ঝরঝর করে ঝরতেই থাকে। অবশেষে সবকিছু ক্রমশ শেষ হয়ে যায়। নিঃস্ব শূন্যতায় কোন শব্দ হয় না।
যুবক শিক্ষকের এই মনোগত নিঃসরণ একইসঙ্গে ভাসিয়ে নেয়, ভিজিয়ে দেয়, আত্মক্ষোভে স্ফীতকায় করে তোলে পাঠক-বোধ। সচেতন পাঠকমাত্রই সক্রিয় হয় স্ফীতি-নিষ্কাশনে চোখ কচলে তাকায় সমাজস্থিত নির্বিশেষ ভণ্ডমী আর কলুষতার দিকে। এভাবেই ঘটে, ভাষা যখন কেবল মনোগহীনের ছবি তুলে ধরে, বহিরঙ্গের বর্ণনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অপ্রকাশিত অন্তরের কথাগুলোও তখন বার্তা হয়ে, কখনো নৈতিক-আদর্শ হয়ে, কখনোবা অনুভূতি প্রকাশের বাড়তি অলঙ্কার হয়ে বিশেষ ভাবানুষঙ্গে জায়াগা করে নেয় পাঠকের রুচিতে। একইসঙ্গে লেখকও মিটিয়ে নিতে সক্ষম হন তাঁর স্বতন্ত্র কৃতিত্বের দাবী। চাঁদের অমাবস্যার স্রষ্টা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তেমনই এক কৃতিমান ভাষার কারিগর।
Discussion about this post