কল্পনা হেনা রুমি
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, যুদ্ধ, ধ্বংস আর পুনরুত্থান মানব-ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুগে যুগে নানা বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত হয়েছে মানুষ। তবে একবিংশ শতকের আধুনিক সময়ে ‘বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি’ —এ বাণীর মর্ম করোনাকালে সবাই যেমন একসঙ্গে উপলব্ধি করেছে, তেমনটা অন্যসময়ে কমই করেছে। আর এই সামূহিক সত্য যখন উপন্যাসের শিরোনাম, তখন পাঠক বৈশ্বিক অবস্থার পাশাপাশি নিজের মনোগত শংকাকেও অবচেতনে খোঁজ করে। মাওলা প্রিন্সের উপন্যাসটি সেই যুগল আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছে। এতে রয়েছে কখনো ব্যক্তির ভেতরে সমষ্টির সমন্বয়, কখনো সমষ্টির মাঝে ব্যক্তির অনুরণন।
পল্লীর নস্টালজিক অস্তিত্ব আর নগরের প্রবহমান জীবনধারার মিথষ্ক্রিয়া আমাদেরই জীবনযাত্রার উন্মোচন। ব্যক্তিক-পারিবারিক-সামাজিক আবহে কথক যে সমস্যা-সংকুল সময়কে উপস্থাপন করেছে, তা যেমন তার সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ; তেমনি কখনো কখনো কথনের কৌশলে তা পৌঁছে গিয়েছে জাতীয় জীবনের অতীত অধ্যায়ে। ফলে ব্যক্তির সংকট জাতিসত্তার অস্তিত্বের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে।
দিদি বা দাদির সারল্য আর বঞ্চিত জীবনের উপাখ্যানের মতোই নারীরা এই উপন্যাসে শেকড়-সংশ্লিষ্ট হয়ে চিত্রিত হয়েছে। তেমনি পুরুষ চরিত্রসমূহও তাদের দক্ষিণ-এশীয় নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে এড়াতে পারেনি। আর নানা কথার ফাঁকে তাদের জীবনের খণ্ড খণ্ড ঘটনা উল্লেখ করে সামগ্রিকতার পথে নিয়ে যাওয়াও আখ্যান বয়নের একটি বিশেষ ধরন বলে প্রতীয়মান হয়।
উপন্যাসে ঘটনার স্রোত কখনো উল্লম্ফনে গিয়েছে অতীতে, কিন্তু বর্তমান থেকে বিচ্যুত হতে দেয়নি পাঠককে। প্রথমে পড়তে গিয়ে দীর্ঘবাক্য দেখে খানিক ভয়ই লেগেছে। কিন্তু, উপন্যাসটির ভাষা যেন পিচ্ছিল, পড়ে যাওয়ার মতো নয়; শিশুদের স্লাইডারের মতো গড়িয়ে নিয়ে যায়, কোথাও আটকাতে দেয় না। দেখতে দুর্বোধ্য হলেও পড়তে সহজপাঠ্য। তাই চেতনাপ্রবাহ বলে যা আমরা জানি, একে তা মনে হয় না, এ যেন চেতন সত্তার নির্মল ধারা-বিবরণী।
উপন্যাসটিতে প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষার মিলিত ও পৃথক ব্যবহারটি ঔপন্যাসিকের নিজস্ব স্টাইল। আর আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ-দক্ষতা তাঁর জন্মস্থানের অবদান সম্ভবত। করেছে অথবা করেছেন, এরূপভাবে কর্তাকে তুমি ও আপনির দোলায় রাখা, কখনো ক্রিয়াকে সম্ভাব্যতার কোটরে ছেড়ে দেয়া বিশেষভাবে ব্যক্তিকে সবার করে তোলার এক প্রাতিস্বিক ধরন। তবে কিছু স্থানে তা অতিপৌনঃপুনিক মনে হয়। যদিও উপন্যাস-সাহিত্যের অগ্রজ অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার বা দেবেশ রায়ের লেখায়ও এমন কিছু বিশেষ ধরন লক্ষণীয়।
সর্বোপরি বলা যায়, যখন করোনাকালে বা করোনা নিয়ে রচিত সাহিত্য অবলম্বনে গবেষণা হবে, তখন মাওলা প্রিন্সের “বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি” উপন্যাসের নাম থাকবে। তাই এটি একটি সময়ের দলিল। এজন্য ‘মাস্ক’ শব্দটির মুদ্রণ-প্রমাদ ‘মাক্স’ পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করা প্রয়োজন।
উপন্যাস পড়তে গিয়ে জানতে ইচ্ছা হয়েছিলো ঔপন্যাসিকের বাড়িতেও কি একটি সংশোধন-অপেক্ষ পারিবারিক কবরস্থান রয়েছে, কিংবা কথকের তিন সন্তানের মায়ের মতো তাঁর মর্মসঙ্গিনী সুষমি ভাবিও কি রাতে বিস্কুট বা খেজুর খান? যদি তাই হয়, তবে এই উপন্যাসে আত্মজৈবনিক কিছু প্রক্ষেপ রয়েছে। রয়েছে বাস্তবের নারী-পুরুষ সম্পর্কের অনন্যতা। অম্ল-মধুর ব্যক্তিত্ব মাওলা প্রিন্সের অজানা কিছু জীবনকথাও হয়তো সাহিত্যিক জবানে জেনে গিয়েছি আমরা।
সংশোধন-অপেক্ষ যে কবরস্থানের ইংগিত বারবার আলোচ্য উপন্যাসে পাওয়া যায়, তা কেবল শব্দগত অর্থেই সীমাবদ্ধ নয়। এই কবরস্থান হয়ে ওঠে একাধারে মৃত বিবেকসম্পন্ন রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক সমাজ-ব্যবস্থার প্রতীক। এর সংস্কারবাসনার রূপকে মানবতার পুনরুদ্ধারই উপজীব্য। বংশপরম্পরায় তথা যুগের ধারাবাহিকতায় অনেকে এই সংস্কার করতে ইচ্ছুক হয়েও সফল হয়নি, কেউবা অগ্রসর হয়নি। কথক যেন তাই নিজেই সেই ভার তুলে নিয়ে হাজার বছরের মানবেতিহাসকে জরামুক্ত করতে চায়। চান। অধুনা করোনার কবলে আহত পৃথিবী কথকের এরূপ প্রতিশ্রুতির প্রয়াসে সবল হয়ে উঠুক, বার্তাটি পৌঁছে যাক সবার হৃদয়ে।
ঔপন্যাসিক মাওলা প্রিন্সের জন্য একরাশ শুভকামনা।
Discussion about this post