অনীক মাহমুদ
আমার যে কয়জন ছাত্র সাহিত্যপাঠ গ্রহণ করে সাহিত্যের পঠন-পাঠন ও সৃজন প্রক্রিয়ায় নিমগ্ন আছে, তাদের মধ্যে মাওলা প্রিন্স অন্যতম। তার সাহিত্যানুরাগ ছাত্রজীবন থেকে উৎসারিত হয়ে কর্মজীবনের নানান পরিসরে ক্রমশ বেগবান ও ঊর্মিমুখর হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় যে দুটো প্রধান ধারা থাকে এক. শ্রেণিকক্ষে সফলভাবে পাঠদান, দুই. দেশজাতির জন্য গবেষণা করা। সেখানেও মাওলা প্রিন্সের সরব কর্মপ্রাণনা চোখে পড়ে। তার ছাত্র-ছাত্রীদের লেখায় ও মন্তব্যে এই সফলতার দৃষ্টান্ত মিলবে। শিক্ষকতাজীবনে তার যে পেশাদারিত্ব দুটো ক্ষেত্রেই ঔজ্জ্বল্য প্রতীয়মান। মাওলা প্রিন্স আনুষ্ঠানিক গবেষণা করে উচ্চতর পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেছে। তার গবেষণা অভিসন্দর্ভ ‘নজরুল ও জীবনানন্দের কবিতায় পুরাণ ও চিত্রকল্প’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে (২০২২)। গবেষণাকর্মটি উচ্চমান-সম্পন্ন। এ পর্যায়ে পরীক্ষণ কার্যে যুক্ত হতে পেরেও প্রীতিবোধ করেছি।
নিজের ক্যারিয়ার কিংবা সৌষ্ঠব বিবর্ধন করে মাওলা প্রিন্সকে আমি নিষ্ক্রান্ত হতে দেখিনি। নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে গবেষণা-অনুরাগ তৈরিতেও তার সোৎসাহ দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে দেখেছি। নিজে সৃজনশীল কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক হয়েও সাহিত্যের একাডেমিক কর্মপ্রাণনাকে প্রিন্স বরাবরই আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করেছে। কাজেই সাধনা করে যারা সিদ্ধি অর্জনের পথকে মসৃণ ও সুষম করার ক্ষেত্রে নিষ্ঠার পথ বেছে নিয়েছে, আমার ছাত্রদের মধ্যে প্রিন্স সেখানেও অগ্রণী।
মাওলা প্রিন্সের শিক্ষক চরিত্রের একটি সুখদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আদর্শিক পথে নিজের গন্তব্যধারাকে পুষ্ট করা। জীবনের এই সত্যসন্ধ উপলব্ধি কেউ ধারণ করে, কেউবা করতে পারে না। জ্ঞানবান সুপুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার আগে শিক্ষককে আদর্শবান হতেই হয়। একারণেই বলা হয়, ‘দুর্জন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য।’ আদর্শবোধ, জ্ঞানানুশীলন ও অক্লান্ত পরিশ্রম একজন মানুষের মহৎ হয়ে গড়ে ওঠবার সোপান। মাওলা প্রিন্স অল্প বয়সে যেভাবে চোখ-কান খোলা রেখে নিজের সাধনায় নিমগ্ন হতে পেরেছে আমাদের ধারণা এগুলো অব্যাহত থাকলে উদিষ্ট সীমায় অবস্থান নেওয়া তার জন্য সহজ হবে। তার ভেতরে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সীমাহীন আকুতিও দেখেছি। কৃতজ্ঞ মানুষরাই জীবনযুদ্ধে সতত বিজয়ী হয়। তারা নিজের অধ্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে পরিপার্শ্ব ও মানুষের সৌহার্দ্য।
মাওলা প্রিন্সের সাহিত্যসাধনার কয়েকটি দৃষ্টিলোক ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। শান্ত স্থিতধী মানুষের চারিত্র্য ধারণ করে তার মধ্যে বেড়ে ওঠে কবিস্বভাব। এটি এখনো আবেগ ও জ্ঞানের প্রস্রবণে একান্তভাবেই এগিয়ে চলেছে। তার প্রকাশিত কাব্য : নিশীথপ্রদীপে শঙ্খঝিনুকের চাষ (২০১৩), দিবারাত্রি প্রেমকাব্য (২০১৪), সব ঠিক, ঠিক কি, ঠিকটা কী (২০১৯), আবার বছর কুড়ি পর (২০২০)। প্রবন্ধগ্রন্থ : কালোত্তরের প্রতিশ্রুতি : প্রসঙ্গ সাহিত্য (২০০৯), রশীদ করীমের উপন্যাস : বিষয়বৈভব ও শিল্পরূপ (২০১৪), অনুধ্যানের নজরুল (২০১৭), কথাসাহিত্য পাঠ ও রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (২০১৯), নজরুল ও জীবনানন্দের কবিতায় পুরাণ ও চিত্রকল্প (২০২২) প্রভৃতি। উপন্যাস : বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি (২০২২)।
মাওলা প্রিন্সের কবিতা মনোধর্মী এবং উৎকর্ষমণ্ডিত গদ্যকে আয়ত্ত করে বিকশিত। এখানে আছে আধুনিক মানুষের রক্তক্ষরণ ও জীবনের খণ্ড খণ্ড জঙ্গমতা। কখনো কখনো ছোট অবয়বে, কখনো মাঝারি কিংবা বড় অবয়বে তার কবিতা উচ্চকিত। এসব বিষয়ে প্রিন্স কোনো সীমার বাঁধনকে একপেশী করে অঙ্গীকার করেনি। ভাবের প্রয়োজনে ভাষা, বিষয়গৌরবে কবিতার অবয়ব বিনির্মাণ-যোগ্যতা পেয়েছে তার কাছে।
প্রবন্ধ গবেষণায় মাওলা প্রিন্স ইতোমধ্যে সাহিত্যলোকে সমঝদার ও সুধীবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নজরুল ও জীবনানন্দের কবিতায় পুরাণ ও চিত্রকল্প-এর অনুসন্ধান তার একটি শ্রমসাধ্য গবেষণা। এই অনুসন্ধানের উপান্তে নজরুল ও জীবনানন্দের তুলনামূলক আলোচনাও গ্রন্থটির সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করেছে। গ্রন্থটি প্রিন্সের একাডেমিক ডিগ্রির প্রয়োজনে রচিত হলেও এর বিষয়গৌরব এবং বিশ্লেষণী তাৎপর্য গভীর ও চেতনাদর্শী।
জন্মদিনের আয়োজনে ‘মুক্তদুয়ার’ আমার এই গুণবান ছাত্রের কৃতি ও কৃতিত্বকে তুলে ধরবার জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সেজন্য আমি তাদেরকে অভিনন্দন জানাই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :
জীবনের ধন কিছু যাবে না ফেলা
ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা
পূর্ণের পদপরশ তাদের পরে।
হ্যাঁ, জীবনের কোনো সঞ্চয়ই ব্যর্থতার জন্য পুঞ্জিভূত হয় না। মহিমা ও মাহাত্ম্য মানুষের কৃতির পরাকাষ্ঠা হিসেবে পরিগণিত হয়। মাওলা প্রিন্স জীবনের সদর্থক কল্যাণার্থকে ধারণ করে মানবিক বোধের ক্ষেত্র-পরিসরে ক্রমশ দীপ্তিমান হয়ে উঠুক, এটাই আমার হার্দিক কামনা। আমার স্নেহভাজন এই ছাত্র, কবি, কথাশিল্পী ও গবেষকের জন্য রইলো আমার একান্ত আশীর্বাদ ও ধ্বনিদ্যোতনা : মাওলা প্রিন্স, চরৈবেতি।
Discussion about this post