১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের মাতৃভাষা আমাদের ঐতিহ্যের অধিকার। এই অধিকার নিয়ে বঞ্চনা বাঙালি জাতি সহ্য করতে পারেননি। তাই লড়াই করে নিজেদের অধিকার রক্ষা করেছেন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথ রঞ্জিত হলেও,আমরা বাঙালিরাই আবার অবহেলা- উপেক্ষা করছি আমাদের সেই রঞ্জিত মাতৃভাষাকে।ভাষা আমাদের স্বাধীনতার বাহন। কিন্তু সেই ভাষাকে অপ-প্রয়োগ করে একুশের চেতনাকেই মুছে ফেলি আমরা। যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ভাষা আন্দোলন করেছিলেন সেই চেতনা আজ আমরা তথাকথিত শিক্ষিত মহলে খোঁজে পাই না।একটা ভাষার অধিকার নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বীজ উপ্ত হয়েছিলো তা শুধু বায়ান্নর মাঝে না বরং তারও পূর্ব কয়েকটি বছর (১৯৪৬/১৯৪৭) থেকেই শুরু হয়েছিল। আজকে আমরা তরুণ সমাজ কতটুকুই বা সেই ইতিহাস লালন করে আসছি!!
বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা।আমরা এই ভাষার এতো অবাধ ব্যবহার বা অপব্যবহার করতে পারছি এই জন্য যে আমাদের ভাষা শহিদ ভাই তাঁদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে একটি ‘অ’ অথবা ‘ক’ কে কিনে দিয়েছেন বলেই। আমরা আমাদের সেই ভাইকেই এখন বলি ‘ব্রো’।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতায় কবি বলেছিলেন “যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে /চেয়েছে তাদের জন্যে/আমি ফাঁসির দাবি করছি।”- (মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী)
আমাদের আজকের দিনেও এমন ফাঁসি দরকার নয় কি!!!
আমরা এখন বাংলা ভাষায় পড়া একটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা জিজ্ঞেসও করে ফেলে ”আচ্ছা তোমাদের বাংলা বিভাগে সব বাংলাতে হয় তাই না? আমাদের সব ইংরেজি ”শুধু তাই নয়,আরও বলে-“পরীক্ষায় কিছু না পারলেও বাংলা হলে কিছু লিখা যায় ইংরেজি তো তাও করা যায় না,তোমাদেরই ভালো সুবিধা”…এই ধরনের মন্তব্য শুনে প্রায়শই খুব কষ্ট হয়, মনে মনে বলি বাংলা ভাষায় পড়ি গর্বিত তাতে এবং তা মন থেকেই বলি কোনো রকম অপমানবোধ থেকে নয়। এছাড়া এমনও বাঙালি দেখি যারা বাংলা ভাষায় কথা বলতে জানেনা বা শিখেইনি বা শেখায়নি; আবার রীতিমতো অহংকারে কেউ কেউ বলেও দেয়, ‘আমি তো বাংলা শেখার দরকার মনে করি না এটা কোনো ভাষা হলো এতো প্যাঁচ!’ তবে আমার মনে হয় আমরা সচেতন বাঙালি হতে হলে নিজেদের ঐতিহ্যেও সচেতন হতে হবে,শ্রদ্ধা থাকতে হবে। বাঙালি নব জাগরণ নিয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত বাঙালিদের বলেছিলেন- “নিরীহ বাঙালি “। কিন্তু মনে হয় তিনি আরও কিছু বিশেষণ যুক্ত করতে পারতেন! শুধু নিরীহ বলে আখ্যা করলে সবটা যেন বলা হয়ে ওঠে না!
এত গেল ভাষা চিন্তার একটি দিক।অন্যটি হলো আমাদের যুগ। আমরা কেন অন্য যে কোনো বিদেশি ভাষা শেখার এতো বেশি প্রয়োজন বোধ করি? যদি মোটাদাগে বলি তা হলো আমাদের জীবিকা। কারণ জীবন ধারণের জন্য জীবিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন অন্য দেশের পদ্ধতিতেই আমাদের সেই মাধ্যম সহজ ও লাভবান মনে করি, বা লাভবান হইও,তখন তাহলে নিজ দেশের ভাষাই বলি বা ঐতিহ্য- সংস্কৃতিই বলি আস্থাশীল হতে পারিনা। আমাদের নিজেদের দেশে নিজেদের ভাষার যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তখনই হবে যখন প্রাপ্তিতে বঞ্চনা থাকবে না। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিও ম্লান থাকবে না।
তবুও সেটা যাই হোক হৃদয়ে বা মননে ভাষার চেতনাটা থাকা আবশ্যক। আপনি যুগধর্মের সাথে চলুন সেটা বড়ো কথা নয়,বরং দৃষ্টিকটু তখনই যখন আপনি নিজ মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করছেন,উপেক্ষা করছেন।কিন্তু যা চলছে তাতে কবির মতো ভয় হয়- “মাগো, ওরা বলে /সবার কথা কেড়ে নেবে।” (আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)
কেড়ে নিয়ে নিজেদেরকেই বরং ফাঁপা করছে বা করবেও!
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন শিক্ষার্থী হয়ে আমার একান্ত আহ্বান বাংলা ভাষাকে সম্মান করুন, ভালোবাসুন। আপনার লক্ষ্য অনুযায়ী বাংলা ভাষাকে উপযোগী করে তুলুন। আর যারা কর্ণধার আছেন তাঁদের কাছেও এই প্রত্যয় যেন, বাংলাকে সরকারি, বেসরকারি অফিস আদালতে উচ্চ মর্যাদার ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে মহিমান্বিত করবেন। বিলুপ্তি নয়,সমন্বয়ের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে মহিমান্বিত করুন।
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” কে ভুললে নিজের পূর্ব পুরুষকেই ভুলে যাওয়া হবে। আসুন আমরা বাংলায় কথা বলি, গান গাই, কবিতা লিখি। বাংলাকে ভালোবাসি।
তথ্যসূত্র :
১. মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’, প্রথম পাঠ : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, চট্টগ্রাম।
২. আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘রোকেয়া রচনাবলী’ প্রকাশ সাল : ২০০৬, পৃ : ২২, বাংলা একাডেমি।
৩. আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ‘কোনো এক মা’কে’, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত “একুশে ফেব্রুয়ারী “সংকলন, প্রকাশ সাল : ১৯৫৩।
Discussion about this post